কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছর বেশি মুনাফার আশায় অসাধু পশু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটা-তাজাকরণ করে বাজারে নিয়ে আসে। স্টেরয়েড দিয়ে মোটাতাজা করা গরু দেখতে আকর্ষণীয়, চকচকে ও হৃষ্টপুষ্ট হয়। বিভিন্ন ধরনের ঔষধ, ইনজেকশন ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে কোরবানির পশুকে মোটাতাজা করে থাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা গরুর মাংস খেলে মানুষের শরীরে পানি জমে যাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, মূত্রনালি ও যকৃতের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষতিকর উপাদান রান্নার পরও মাংসে থেকে যায়। এই মাংস খেলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেশে প্রায় এক কোটি গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া কোরবানি দেওয়া হয় যার প্রায় ৭০ ভাগই গরু। সবাই সামর্থ্য অনুযায়ী সুন্দর মোটাতাজা গরু কোরবানি দিতে চান। অনেক সময় গরু মোটা পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু সুস্থ গরু পাওয়া যায় না।
কিছু বিষয় জানা থাকলে সুস্থ এবং ঔষধ খাইয়ে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা পশু চেনা যায়। পশুকে স্টেরয়েড বা হরমোন প্রয়োগ করা হলে তা পশুর প্রস্রাব বন্ধ করে দেয়। ফলে পশুর চামড়ার নিচে পানি জমতে থাকে এবং তা ফুলে যাওয়ায় পশু স্বাস্থ্যবান দেখায়। মৎস্য খাদ্য পশু খাদ্য আইন ধারা ১৪তে বলা হয়েছে, গবাদি পশুর হৃষ্টপুষ্ট করণে কোন প্রকার হরমোন স্টেরয়েড এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অসাধু পশু ব্যবসায়ীরা অর্গানিক উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ করলেও দেশীয় পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ করছেন শিক্ষিত তরুণ খামারিরা।
বিদেশ থেকে গরু আসা নিয়ে সংকট, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, অস্বাস্থকর পশু কোরবানী থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই দেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা গবাদিপশু লালন-পালনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অনেকে মূল পেশার পাশাপাশি এসব খামার গড়ে তুলছে। আর্শ্চায্য হলেও সত্য যে, ঢাকায় ছাদের উপর গরুর খামারের সংবাদ পাওয়া যায়। নানা প্রতিবন্ধতকতাকে উপেক্ষা করে প্রতিবছর দেশে নতুন গবাদিপশুর খামার যুক্ত হচ্ছে। মূলত, কোরবানির হাট ও দুধ বিক্রির লক্ষ্য নিয়ে শুরু হওয়া এসব খামারের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা হচ্ছে শিক্ষিত তরুণ। এসব তরুণ কোরবানির হাটে যে পরিমাণ গরু-ছাগলের যোগান দিচ্ছে, তাতে বিদেশ থেকে আর আমদানির দরকার হবেনা। উল্টো দেশের গরুর চাহিদা মিটিয়ে গরু উদ্বৃত্ত সম্ভব হবে।
উচ্চশিক্ষিত এসব তরুণের গরুর খামার কেউ যদি দেখতে চান, তাহলে খুব বেশি দূর যেতে হবে না। চট্টগ্রাম নগরের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তিনজন শিক্ষার্থী নিজেদের প্রয়োজন মিটাতে পছন্দমতো গরু কিনে আরেফিন নগরে ফ্রেন্ডস অ্যাগ্রো ফার্মের নামে গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করে। পরিকল্পনা ছিল শুধু নিজেদের জন্য আর নিকটতম আত্বীয়-স্বজন ও বন্ধুদের কাছেই সুস্থ গরু সরবরাহ করা ।গত তিন-চার বছরে ধরে গড়ে ওঠা এসব খামারে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। এসব যন্ত্র ও প্রযুক্তি দিয়ে খামারের বাইরের ও ভেতরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে। রয়েছে পরিচ্ছন্ন পরিবেষ।
প্রত্যেকটি গরু সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে কাঁচা ঘাস, খড়, তিলের খৈল, ছোলার খৈল, মটরসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করা হয়। গরুর চাহিদা থাকায় প্রতিবছর অনেকে খামার থেকেই গরু কিনতে চায়। বিশেষ পদ্ধতিতে পালন করা এসব গরুর প্রতি শহুরে ক্রেতাদের কাছে অনেক আগ্রহ দেখা যায়। কারন অনেকে পরিবার নিয়ে গরুর খামারে গিয়ে পরিবারের সকলের পছন্দ মত গরু কিনতে খুবই উৎসাহী থাকে।এই গরুগুলি অন্তত: ছয় মাস আগে থেকে বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত বাজার থেকে এই নিয়ে আসা হয়। তবে বাজারের প্রচলিত ধরনের গরুর চেয়ে এ ধরনের গরুর দাম একটু বেশি। কোন ধরনের ঔষধ ব্যবহার না করে, স্টেরয়েড না খাইয়ে পরিষকারভাবে গরু পালা হচ্ছে, এটাই অর্গানিক গরু। খড়, ঘাস, ভুষি, তারপর ভুট্টার সাইলেজ খাইয়ে সুস্থ রাখা হয় গরুগুলোকে।বতর্মানে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ার কারনে অর্গানিক পদ্ধতিতে পালন করা গরুর চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। দেশীয় খাবার ছাড়া অন্য কোনো ভিটামিন খাওয়ানো হয় না। এতে খামারের গরুর শরীরে চর্বি কম, মাংস বেশি থাকে। ফলে খামারের গরুর মাংস স্বাদ বেশি। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ঠিক কতগুলো খামারে অর্গানিক পদ্ধতিতে গরু পালন করা হচ্ছে তার সঠিক হিসেব নেই। অর্গানিক পদ্ধতিতে পালন করা গরুকে যেসব জিনিস খাওয়ানো হয়, সেসবও তো আমাদের দেশেই তৈরি হয়। এ খাতে যদি সহযোগিতা পাওয়া যায় খামারিরা উৎসাহিত হবে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমবে, সর্বপরি সুস্থ গরু পাওয়া যাবে।
করোনা ভাইরাসের কারণে খামারে আসা ক্রেতার সংখ্যা কম এবং মানুষ নানা সঙ্কটে। এবারের ঈদে অর্থ সংকটের কারণে অনেকেই কোরবানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। আর পশুর হাটে মানুষের ভিড় বেশি হওয়ার সম্ভাবনায় করোনা ভাইরাসের কারণে অনেকেই হাটে আসবে না। আর অনলাইনে আস্থার অভাবে পশু বিক্রি কেমন হবে তা নিয়েও অনেকে শঙ্কায় রয়েছে। যে কারণে চাহিদার তুলনায় কোরবানির পশুর সংখ্যা বেশি থাকা সত্তেও পশু কম বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। আর গত বছরের তুলনায় এবারের গো খাদ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। এজন্য পশু পালনে তাদের খরচও অধিকাংশে বেড়ে গেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কোরবানির প্রাণী বেচা-কেনার জন্য ই-কমার্স প্লাটফরমগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখা যাচ্ছে । যত্র-তত্র হাটের চেয়ে খামারিদেরকে আরও বেশি গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে, ই-কমার্স প্লাটফরমগুলো আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গরুর হাটগুলোতে প্রচুর নগদ লেনদেন ব্যবসায়ী এবং গ্রাহকদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেবে। অর্থ প্রদানের সুবিধার্থে এবং এই ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য, মোবাইল মানি অ্যাপের মতো ডিজিটাল সেবাগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদরা ঠিকাদারিসহ শিল্প কারখানা ও বিভিন্ন ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেও অনেক তরুণ চলছেন ভিন্ন পথে। বর্তমানে দেশের অনেক তরুণ এগ্রোভিত্তিক খামারে বিনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতির অন্যান্য খাত চাপের মুখে থাকলেও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খামারের সংখ্যা। এ কারণেই গবাদি পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। কোরবানিকে সামনে রেখে বিশুদ্ধ উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণের যে উৎসাহ খামারিদের তৈরি হয়েছে, খামারিদের এই উৎসাহ ধরে রাখতে হবে। শুধু কোরবানি নয়, সারাবছরের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে মাংস রফতানি করারও উদ্যোগ নিচ্ছেন এ খাতের বিনিয়োগকারীরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে হালাল মাংস আমদানির আগ্রহ দেখিয়েছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর এবং টেকসই উন্নয়ন কর্মী