কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সামান্য প্লাস্টিক আর ধাতুর তৈরি ফ্রেমে একজোড়া কাচ জুড়ে দিয়ে চশমা তৈরিতে যেখানে খরচ হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৫-৫০ ডলার, সেটি কিনতে একজন ক্রেতা কেন ৫০০ ডলার (৪২ হাজার টাকা) খরচ করবেন। শুধু ব্র্যান্ড আর লোগোর কারণে কেন উত্পাদন খরচের বহুগুণ বেশি দাম রাখা হবে?
বিশ্বজুড়ে চশমা ও সানগ্লাসের বাজারে এ অনৈতিক বাণিজ্য করে আসছে ইতালির একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বিশ্বের নামি চশমার বাজারের ৮০ শতাংশেরও বেশি অংশ লাক্সোটিকা নামের এ প্রতিষ্ঠানের একক নিয়ন্ত্রণে। তারাই নির্ধারণ করে প্রাডা, রে ব্যান, ভারসেস, বারবেরি, রালফ অ্যান্ড লরেন, টিফানি, বুলগারি, পারসল ও ওকলেসহ বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর চশমা ও সানগ্লাসের দাম। মূলত বর্তমানে সারা দুনিয়ায় ১১৪ দশমিক ৯ বিলিয়িন ডলারের (স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী) চশমার বাজারে একচ্ছত্র ‘মাফিয়া’ লাক্সোটিকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক চশমার বাজারে লাক্সোটিকার তীব্র মনোপলি চলছে। এ প্রতিষ্ঠানই ঠিক করে দিচ্ছে কোন ব্র্যান্ডের চশমার কেমন দাম হবে। পণ্যের মানের ওপর নয়, বরং এ দাম ঠিক করা হচ্ছে একটি নামি ব্রান্ডের অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে খদ্দের কত টাকা খরচ করতে ইচ্ছুক তার ভিত্তিতে।
তাছাড়া অন্য পণ্যের বাজারে যেমন প্রতিযোগিতার সুযোগ রয়েছে, চশমার ক্ষেত্রে তেমন নেই। কারণ, এ বাজারে নিজের নিয়ন্ত্রিত ব্র্যান্ডের মধ্যে এক ধরনের ছদ্ম প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রেখেছে লাক্সোটিকা। অন্য কাউকে ঢুকতে না দিয়ে একাই নিয়ন্ত্রণ করছে বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের চশমা উত্পাদন থেকে গ্রাহকের কাছে বিক্রি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া। আর এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছেমত ক্রেতার পকেট কাটছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লাক্সোটিকার অধিগ্রহণের আগে রে ব্যানের যে সানগ্লাস গ্যাসস্টেশনেও মাত্র ১৯ ডলারে বিক্রি হতো, একই সানগ্লাস লাক্সোটিকা তার নিয়ন্ত্রিত দোকানে এখন বিক্রি করছে ১৫০ ডলারেরও বেশি দামে।
যদিও লাক্সোটিকার কর্মকর্তাদের দাবি, যারা নিয়মিত চশমা ব্যবহার করেন, একজোড়া ভালো চশমার জন্য একটু বেশি খরচ করতে তাদের আপত্তি নেই। আর তাদের পণ্য মানেও অনন্য।
লাক্সোটিকার এক প্রতিনিধির বক্তব্য, লাক্সোটিকা কোনোভাবেই মনোপলি করছে না। ২০১৭ সালে বিশ্বে ১০০ কোটি চশমা বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৯ কোটি ৩০ লাখ লাক্সোটিকার তৈরি, যা মোট বিক্রিত চশমার ১০ শতাংশেরও কম। একই সঙ্গে বিশ্বে চশমার হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ড রয়েছে। এর মধ্যে লাক্সোটিকা নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র ৩০টির মতো ব্র্যান্ড।
কিন্তু মানের অজুহাত দেখিয়ে ক্রেতার অজান্তে উত্পাদন খরচের বহুগুন বেশি দামে পণ্য বিক্রির বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন অনেকেই। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক টিম উ বলেন, আমরা দেখেছি, কিছু পণ্য দিন দিন যেমন উন্নত হচ্ছে, সেই সঙ্গে সেগুলোর দামও কমছে। যেমন ল্যাপটপ। কিন্তু চশমার মতো কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এর ঠিক উল্টোটা ঘটছে। বাহ্যিক কিছু পরিবর্তন ছাড়া এ শিল্পে তেমন কোনো উদ্ভাবন ঘটেনি। কিন্তু দামের বেলায় সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর এ জন্য তিনিও দায়ী করছেন চশমা বাজারের মনোপলিকে।
চশমার খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান লেন্সক্রাফটার্সের এক সময়কার অন্যতম ফ্রেম সরবরাহকারী ছিলেন বিখ্যাত ডিজাইনার চার্লস ডাহান। পরে প্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণ করে লাক্সোটিকা। লাক্সোটিকার মনোপলির বিষয়ে তিনি বলেন, যে চশমার ফ্রেম তৈরিতে ২০ ডলার খরচ হয়, সেটি লাক্সোটিকা বিক্রি করছে অন্তত ১০০ ডলারে। আর তথাকথিত ‘ডিজাইনার ফ্রেম’ হলে দাম নেয়া হয় ২০ গুণ পর্যন্ত।
লাক্সোটিকার অধিগ্রহণ করা বিভিন্ন ব্র্যান্ড: মোটকথা, চশমার বৈশ্বিক বাজারে এখন আর কোনো প্রতিযোগিতা নেই। সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কিনে নিয়েছে লাক্সোটিকা। লেন্সক্রাফটার্স ছাড়াও পার্লে ভিশন, সিয়ার্স অপটিক্যাল, সানগ্লাস হাট ও টার্গেট অপটিক্যালের মতো চশমার চেইনশপও কিনে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই লাক্সোটিকার নিয়ন্ত্রিত চশমা বিক্রির দোকান রয়েছে ৭ হাজারেরও বেশি। ফলে চশমার বাজারে লাক্সোটিকাই সর্বেসর্বা। আর এভাবে প্রতিষ্ঠানটি অন্যায়ভাবে নির্ধারিত দামে চশমা কিনতে বাধ্য করলেও ক্রেতারা কিছুই টের পাচ্ছে না।
সূত্র: ফোর্বস ও লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস