এলিট ফোর্স হিসেবে র্যাব আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই আইনের শাসন সমুন্নত রেখে দেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে অপরাধ চিহিৃতকরণ, প্রতিরোধ, শান্তি ও জনশৃংখলা রক্ষায় কাজ করে আসছে। বর্তমান সময়ে মানবপাচাকারী চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ফাঁদ, যেমন বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকুরী দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ জনগণের সরলতার সুযোগ নিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানী মানবপাচারকারী চক্র। এ ধরনের মানবপাচারকারী চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য র্যাব সদা সচেষ্ট।
ভুক্তভোগী কতিপয় ভিক্টিমরা র্যাব-৩ এ অভিযোগ করেন, একটি চক্র তাদেরকে ভ্রমণ ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে প্রেরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু অভিযোগকারী ভিক্টিমরা বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া অবৈধভাবে বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানান এবং টাকা ফেরত চান। তখন উক্ত মানবপাচারকারী চক্র নকল বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে ভিক্টিমদের সরবরাহ করে। উক্ত নকল কার্ড নিয়ে ভিক্টিমরা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন করতে গেলে বিমানবন্দরে কর্তব্যরত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সদস্যরা ভিক্টিমদের ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল হিসেবে সনাক্ত করেন এবং ভিক্টিমদের বিদেশ যাত্রা স্থগিত করেন।
এসময় ভিক্টিমরা তাদের সংশ্লিষ্ট দালালদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি এবং ভিক্টিমদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অতঃপর ভিক্টিমের দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর আভিযানিক দল গোপন সংবাদের মাধ্যমে তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন ডিএমপি ঢাকা এবং কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় শনিবার (৬ নভেম্বর) রাত হতে সকাল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্রের সদস্য ১। মোঃ নাইম খান ওরফে লোটাস (৩১), সাং-মিরকুমুলি, পোঃ করটিয়া, থানা-দেলদুয়ার, জেলা-টাঙ্গাইল, ২। মোঃ নুরে আলম শাহরিয়ার (৩২), সাং-কোরবানপুর, থানা-বাঙ্গরা বাজার, জেলা-কুমিল্লা, ৩। মোঃ রিমন সরকার (২৫), সাং-চকচন্দ্রপুর, থানা-কসবা, জেলা-ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, ৪। মোঃ গোলাম মোস্তফা সুমন (৪০), সাং-কোরবানপুর, থানা-বাঙ্গরা বাজার, জেলা-কুমিল্লা, ৫। মোঃ বদরুল ইসলাম (৩৭), সাং-বানছানগর, থানা-লক্ষিপুর সদর, জেলা-লক্ষিপুর, ৬। মোঃ খোরশেদ আলম (২৮), সাং-বালিয়াকান্দি নতুন বাজার, থানা-সেনবাগ, জেলা-নোয়াখালী, ৭। মোঃ সোহেল (২৭), সাং-দক্ষিণ ফ্যাশন, থানা-চরফ্যাশন, জেলা-ভোলা এবং ৮। মোঃ হাবিব (৩৯), সাং-ত্রিমোহনী, থানা-খিলগাঁও, ডিএমপি, ঢাকাদেরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। ধৃত আসামীদের নিকট হতে ১। ১৪ টি পাসপোর্ট, ২। ১৪ টি নকল বিএমইটি কার্ড, ৩। ০১ টি সিপিইউ, ৪। ০১ টি প্রিন্টার, ৫। ০১ টি স্ক্যানার, ৬। ০২ বক্স খালি কার্ড, ৭। ০৫ টি মোবাইলফোন, ৮। ০১ টি চেক বই, ৯। ০৫ টি নকল সীল উদ্ধার করা হয়।
আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, মোঃ নাইম খান ওরফে লোটাস (৩১) উক্ত চক্রের মূল হোতা। সে দুবাই প্রবাসী। চলতি বছরের মে মাসে সে দেশে ফেরত আসে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাশ। সে ২০১২ সালে ওয়ার্কপারমিট নিয়ে দুবাই গমন করে। পরবর্তীতে দুবাই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দুবাই শ্রম বাজারে বাংলাদেশী শ্রমিকদের চাহিদা থাকায় দুবাইয়ের কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় দুবাই অবস্থানকারীদের ওয়ার্কপারমিট দিয়ে কাজের বৈধতা দেয়। উক্ত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধৃত নাইম মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে। সে দুবাইয়ে এবং বাংলাদেশে তার পরিচিতজনদের মাধ্যমে ভিক্টিমদের উচ্চ বেতনে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে দুবাই যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। ভিক্টিম রাজী হলে দুই হতে তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে সে তাদেরকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে থাকে। উক্ত ভিক্টিমরা ভ্রমণ ভিসায় যাওয়ার পর কেউ কেউ কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এভাবে সে ০৭ বছর ধরে পাঁচ শতাধিক ভিক্টিমকে দুবাই পাচার করেছে। মানবপাচার হতে অর্জিত অবৈধ উপার্জন দিয়ে সে দুবাইয়ে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয় এবং নিজে রেসিডেন্স ভিসার অনুমোদন নেয়।
এসব বিষয়ে ধৃত নাইমকে তার সহযোগীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায়, দুবাইয়ে ফারুক নামে তার একজন সহকারী রয়েছে এবং ধৃত মোঃ নুরে আলম শাহরিয়ার (৩২) বাংলাদেশে তার মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করে। শাহরিয়ার ভিক্টিমদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে দেয়। ধৃত শাহরিয়ারের কসবা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান রয়েছে। সে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া হতেই ভিক্টিমদের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কিছু ভিক্টিম বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানালে ধৃত শাহরিয়ারের মাধ্যমে বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্র উক্ত মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িত হয়।
বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের মূল হোতা হাবিব এবং খোরশেদ। তারা দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত গোপনে নিজেদের আড়ালে রেখে বিশ্বস্ত জনের মাধ্যমে ভিক্টিমদের নকল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে ধৃত নাইম বিএমইটি কার্ড ছাড়াই মানবপাচার করে আসছে। ভিক্টিমরা বিএমইটি কার্ড দাবী করলে ধৃত শাহরিয়ার তার চাচা ধৃত মোঃ গোলাম মোস্তফা সুমন (৪০) এর সাথে যোগাযোগ করে। তখন ধৃত সুমন জানায় ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সে ১টি বিএমইটি কার্ড দিতে পারবে। ধৃত নাইম ভিক্টিমদের বিএমইটি কার্ড সংগ্রহ করার জন্য শাহরিয়ারের মাধ্যমে ১৩টি পাসপোর্ট সুমনের নিকট হস্তান্তর করে। ধৃত সুমন ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে ১টি বিএমইটি কার্ড হিসেবে উক্ত পাসপোর্ট ধৃত বদরুলের নিকট হস্তান্তর করে। ধৃত বদরুল ১ হাজার টাকার বিনিময়ে ১টি বিএমইটি কার্ড হিসেবে উক্ত পাসপোর্ট ধৃত খোরশেদের নিকট হস্তান্তর করে। ধৃত খোরশেদ ৬৫০/টাকার বিনিময়ে ১টি বিএমইটি কার্ড হিসেবে উক্ত পাসপোর্ট ধৃত হাবিবের নিকট হস্তান্তর করে।
এছাড়া হাবীব প্রদত্ত পাসপোর্টের তথ্য ব্যবহার করে জাল বিএমইটি কার্ড তৈরি করে। এরপর উক্ত জাল বিএমইটি কার্ড খোরশেদ ও বদরুল এর হাত হয়ে সুমনের নিকট পৌঁছায়। ধৃত মোঃ রিমন সরকার (২৫) শাহরিয়ারের নির্দেশে উক্ত জাল বিএমইটি কার্ড সুমনের নিকট হতে সংগ্রহ করে ধৃত নাইমের নিকট পৌঁছে দেয়। নাইম ফ্লাইটের পূর্বে ভিক্টিমদের নিকট উক্ত জাল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করে। ধৃত সোহেল স্থানীয় দালাল হিসেবে কাজ করে। জাল বিএমইটি কার্ড তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে ধৃত হাবিব জানায়, সে মহসিন নামীয় ব্যাক্তির নিকট হতে খালি কার্ড কিনে আনে। প্রকৃত বিএমইটি কার্ড স্ক্যান করে সে নিজেই গ্রাফিক্স তৈরি করে। তারপর ভিক্টিমের পাসপোর্টে দেয়া তথ্য অনুযায়ী কার্ডের পিছনে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয় এবং বদরুলের নির্দেশমত রিক্রুটিং লাইসেন্স এর নাম্বার বসিয়ে দিত। সে চার বছর যাবত ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ড এর ডিজাইন এবং প্রিন্টের ব্যবসা করে আসছে। উক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সে কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নকল কার্ড তৈরি করে সরবরাহ করে আসছে। উক্ত মানবপাচারকারী চক্র ও বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের ফাঁদে পড়ে ভিক্টিমদের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যায়।