হঠাৎ বন্ধু নাজমুল লন্ডন থেকে ফোন করেছে তার মেয়েকে নিয়ে সে বাংলাদেশ বিমানে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর কেন যেন মনে পড়ে গেল আমার স্ত্রী মারিয়া এবং জনাথানের প্রথম বাংলাদেশ ভ্রমণের কথা যা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ। ছেলে এবং তার মাকে নিয়ে আমার জন্মভূমিতে হবে তাদের প্রথম আগমন। যা ছিল চরম উত্তেজনায় ঠাসা অপেক্ষা এবং প্রতীক্ষা।
জনাথানের বয়স তখন নয় মাস। আমরা বাংলাদেশে যাওয়ার প্ল্যান করেছি শুনে মারিয়ার বড় বোন জেন এবং বোনের মেয়ে মালিকাও যাবে বলে বায়না ধরলো। ভাবলাম বেশ মজাই হবে সবাই গেলে তাই সবাই মিলে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। সে অনেক বছর আগের কথা।
জার্নি বেশ ঝুকিপূর্ণ ছিল শুরুতেই। স্টকহোম থেকে লন্ডনে ল্যান্ড করতেই ছয় ঘণ্টা ডিলে কুয়াশার কারণে। পরে প্লেন সরাসরি লন্ডন-ঢাকা না গিয়ে প্রথমে লন্ডন-ব্যাংকক এবং পরে বাংলাদেশ বিমানে ব্যাংকক থেকে ঢাকায় ল্যান্ড করলাম গভীর রাতে।
বিমানবন্দরে এসেছে আমাদের রিসিভ করতে আমার সেজো ভাই হাফিজ এবং ছোটভাই শাহিন। সেজো ভাই থাকেন জার্মানিতে তখন। তিনি কয়েকদিন আগেই দেশে এসেছেন। শাহিন এবং সেজো ভাই সময়মতোই বিমানবন্দরে এসেছে বটে কিন্তু হরতালের কারণে সবকিছু বন্ধ।
সকাল ছয়টার আগে বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। এদিকে যাত্রীরা দুদিন ধরে বিমানবন্দরে আটকে আছে হরতালের কারণে। টয়লেটের অবস্থা থেকে শুরু করে সবকিছুর যে করুণ পরিণতি ছিল যা ভাবতে আজও কষ্ট লাগে। এদিকে আমাদের প্লেন চেঞ্জ হওয়ার কারণে ল্যাগেজ আসেনি।
জার্নির শুরুতেই সবকিছু গড়মিল হতে লাগলো। সারারাত বসে গল্পে কেটে গেল। পরিবেশটা ভালো ছিল না কিন্তু মারিয়া পুরো সময়টাকে নতুন এক অভিজ্ঞতা হিসেবে নিতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে তার ভাবনাতে ঢুকেছে এটাই রিয়েল লাইফ বাংলাদেশের ১২-১৩ কোটি মানুষের।
তার অনুভূতিতে সেদিনের প্রকাশ ছিল কতো ভাগ্যবান সে এমন একটি মুহূর্তকে উপলদ্ধি করার সুযোগ পেয়েছে। আমি যতটুকু তাকে চিনেছি আমাদের প্রায় তিন বছরের পরিচয়ে তাতে বিশ্বাস ছিল সে যখন আমাকে ভালোবাসে তখন আমার দেশ, দেশের মানুষ, দেশের পরিবেশ এবং বাবা-মা, ভাই-বোন সবই তার কাছে ভালো লাগবে।
সকাল ছয়টা বাজতেই রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাড়িতে পৌঁছে সারাদিন আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, ও ঘুরাঘুরির পর রাতে ঘুম। ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ থেকে ল্যাগেজ সংগ্রহ করলাম। দুই দিন ঢাকায় থেকে সবাই একটি মাইক্রো বাসে করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
চট্টগ্রাম শহরে আসতেই সন্ধ্যা লেগে গেল। কী করি! সবাই মিলে চট্টগ্রাম পর্যটন হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম। ড্রাইভারসহ আমরা মোট দশজন। রুমের দরকার চারটি। ম্যানেজারকে আমাদের সমস্যার কথা বললাম, তিনি সবশুনে আমাদের পাসপোর্ট চাইলেন। পাসপোর্ট ঢাকাতে রেখে এসেছি বললাম।
এ কথা শোনার পর তিনি বললেন ‘বিনা পাসপোর্টে আমি আপনাদের হোটেলে রাখতে পারবো না। কারণ পুলিশ জানতে পারলে আমাদের সমস্যা হবে।’ ভাবলাম তাহলে পুলিশের অফিসে যাই। এসপি সাহেব অফিস ছেড়ে কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন তবে এএসপি আছেন। তাকে বিষয়টি বলতেই তিনি আমাদের সবাইকে জেল হাজতে ঢুকিয়ে দিলেন। বিনা পাসপোর্টে ঘোরাঘুরি তাও সঙ্গে বিদেশি। এবার ঠেলা সামলাও।
বড় বড় ক্ষমতাবান আত্মীয়-স্বজন রয়েছে শহর এবং সেনানীবাসে, তা সত্ত্বেও ভালোমতো জেদ চেপেছে যাই হোক না কেন কারো পরিচয় দিয়ে জেলমুক্ত হবো না। দেখার শখ হলো বাংলাদেশের আইনের প্রয়োগ এবং পুলিশের অবনতি বা উন্নতি কতটুকু হয়েছে। এদিকে এএসপি খবর পাঠিয়েছে একলাখ টাকা আমরা দিলে ঝামেলামুক্ত। আমার স্ত্রী এবং তার বোন বিষয়টি জেনেছে এবং বুঝতে পেরেছে যে দুর্নীতি চলছে। সবাই জনাথানকে নিয়ে একটু চিন্তিত এদিকে রাত হতে চলছে, রাতের ডিনারও হয়নি।
আমার বাবা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেছেন কোনো এক সময়। তিনি আমাদের ছোটবেলায় বলতেন সমস্যা হলে পুলিশ
অফিসে গিয়ে বললে সব সময় সাহায্য পাবে। বাবার সেই কথামতো এলাম পুলিশের কাছে আর সঙ্গে সঙ্গে জেল হাজতে! যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছে থানার ভেতরে তাই পুলিশেরই কোনো একজন টেলিফোনে সরাসরি এসপিকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসপি এসে হাজির। আমাদের সবাইকে তার অফিসে আনলেন। বিষয়টি জেনে বেশ লজ্জিত বোধ করলেন এবং এএসপিকে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দিলেন। একই সঙ্গে পর্যটন হোটেলের ম্যানেজারকে অর্ডার করলেন আমাদের রাতের থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। কিছুটা দুঃখ পেলেও পুলিশের ভেতরেও যে কিছু ভালো মনের মানুষ রয়েছে সে বিষয় অবগত হলাম।
আমার পরিবারের কাছে নিজেকে বেশ ছোট মনে হয়েছিল সেদিনের পুলিশের কর্ম এবং আচরণে। রাতে হোটেলে থেকে সকালে রওনা দিলাম কক্সবাজার। তিনদিন কক্সবাজারে আমাদের সময় ভালোভাবে কেটেছিল। পর্যটন হোটেলের সবার সঙ্গে একটি পারিবারিক সম্পর্ক হয়েছিল মাত্র তিনদিনে। তারা ইলিশ, রূপচান্দা মাছ যা হোটেলের মেনুতে নেই তবুও আমাদের জন্য ম্যানেজ করেছে।
আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কথা স্বাভাবিকভাবেই গর্বের সঙ্গে নিজের দেশকে দেখানো আমার স্ত্রী, তার বোন ও ভাতিজিকে ছিলো সত্যি আনন্দের ব্যাপার। ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক, এমন একটি গরিব দেশে এটাই ছিল সবার ধারণা। কক্সবাজারের জার্নি সেরে ফিরে এলাম ঢাকায়।
এবার যেতে হবে গ্রামের বাড়ি নহাটায়। দুদিন ঢাকায় থেকে রওয়ানা দিলাম আরিচা হয়ে মাগুরার উদ্দেশ্যে, সবশেষে নহাটা। রওনা হতেই পথে নতুন চ্যালেঞ্জ। হরতাল ফেরি পারাপার বন্ধ। কী করি পেছনে ফেরার যেমন উপায় নেই, তেমনি উপায় নেই সামনের দিকে এগুনোর। বাংলাদেশ ট্রাক সমবায় সমিতি আরিচা ঘাট অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আমাদের ড্রাইভার গিয়ে কোনোভাবে ম্যানেজ করে আমাদের ফেরি পার হওয়ার ব্যবস্থা করলো এবং আমরা ফেরিতে উঠে দৌলতদিয়ার দিকে রওয়ানা দিলাম।
দৌলতদিয়া নেমে দেখলাম রেস্টুরেন্টে রান্না চলছে টাটকা ইলিশ সঙ্গে আলু ভাজি। খেতে লোভ হলো এবং আমি খেতে শুরু করেছি দেখে মারিয়াও আমার সঙ্গে খেতে শুরু করলো। রাস্তার ধারে বসে বাংলা স্টাইলে পদ্মা নদীর টাটকা ইলিশ মাছ ভাজি না খেলেই নয়। খাবার শেষে রওনা দিলাম মাগুরার উদ্দেশ্যে। মাগুরায় আসতে রাত হয়ে গেল। পরে এসে হাজির হলাম নহাটার নবগঙ্গা নদীর পাড়ে।
গাড়ি এপারে রেখে যেতে হবে নৌকা করে ওপারে। শীতের রাতে খেয়া পারাপার বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কেই নেই। আমার ছোটভাই শাহিনও ঢাকায় পড়াশোনা করে তবে বাড়িতে আসে মাঝেমধ্যে তাই চেনে মাঝিদের। কয়েকজনের নাম ধরে ডাকতেই সিরাজ নামে একজন এসে আমাদের সেই অন্ধকার শীতের রাতে নদী পার করে বাড়িতে দিয়ে গেল। নহাটায় বিদ্যুৎ এসেছে তখন, তবে থাকে না সবসময়।
কিন্তু সেদিন রাতে বিদ্যুৎ ছিল তবে কোনো ঘরেরই বাল্ব কাজ করেনি। বাবা-মা বুঝতে পারেননি হঠাৎ রাতের আঁধারে আমরা এসে হাজির হবো। পরের দিন সকালে গ্রাম ঘুরে, আমার স্কুল, নবগঙ্গা নদী সব কিছু মারিয়া মনের আনন্দে দেখছে। আমার জন্মস্থান যেখানে কেটেছে আমার শিশুকাল এবং বাল্যকাল সে মধুময় দৃশ্য মারিয়া চেষ্টা করেছে আমার মতো করে দেখতে ভালোবাসার হৃদয় দিয়ে।
বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়া শীতের দিনে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের দৃশ্য দেখা, খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরি করা, সন্ধ্যার পর মাটির চুলায় চিতই পিঠা তৈরি করা, গরুর গবর দিয়ে জ্বালানি তৈরি করা, নহাটার পাশে ঝগড়দিয়া গ্রামে কলুপাড়ায় গরু ও কাঠের ঘানি দিয়ে তৈরি তেল তৈরির পদ্ধতি দেখা, ঢেকি দিয়ে ধান ভাঙানো ও চালের গুঁড়ো তৈরি করা, সরিষা ফুলের মাঠে হারিয়ে যাওয়া, আমার স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি, গ্রাম, গ্রামের ধুলোবালি ও গাছগাছালি দেখে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া--- সবকিছু ছিল তার জীবনের নতুন অভিজ্ঞতা।
ঢাকা শহরের কঠিন জীবন থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে হারিয়ে যাওয়া তাও সুইডেন থেকে এসে সত্যি বিশাল ব্যাপার। মাতৃভূমিকে জীবনে প্রথমবারের মতো বিদেশিনী স্ত্রীর কাছে তুলে ধরা ছিল একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ভ্রমণ তার হৃদয়ে ফুলের মতো গেঁথে আছে আজও এবং যা ভেবে ভেবে এখনো সে আবেগে আপ্লুত হয় মাঝেমধ্যে।
সে মুগ্ধ হয়েছিল গ্রামের মানুষকে দেখে। বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক সৌন্ধর্য দিয়ে মুগ্ধ করেছিল মারিয়াকে। অর্থে বা ধন-সম্পদে নয়, মনুষ্যত্ববোধ ও অতিথিপরায়ণতায় মুগ্ধ হয়েছিল সে। কোনো এক সময় সুইডেনে এসে সে এক সামাজিক মিলনমেলায় বলেছিল ঘুরে এলাম হৃদয়ের বাংলাদেশ।
আবার হবে তো দেখা এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো/কী চোখে তোমায় দেখি বোঝাতে পারিনি আজো হয়তো/এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো। জানি না যদি আবার কখনও ফিরে আসি সেই নবগঙ্গা নদীর তীরে কেমন অনুভূতি হবে, সে ভ্রমণে!
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে
ই-মেইল: rahman.mridha@gmail.com