সূত্র জানায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে সোনাসহ আটক হয়েছেন। উড়োজাহাজের সিটের নিচে, টয়লেটে থেকে সোনা উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া, বিমানের নিয়ন্ত্রণাধীন হ্যাঙ্গার কমপ্রেক্স, আমদানি-রফতানি কার্গো ভিলেজ ও বিমানবন্দরে অবস্থিত বিমানের অফিস থেকেও একাধিকবার সোনা উদ্ধার করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর, ও বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ।
সূত্র জানায়, বিমানের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী, সিসি ক্যামেরা থাকার পরও প্রতিনিয়ত চোরাচালানের সঙ্গে বিমানের কর্মীরা জড়িয়ে পড়ছেন। চোরাচালানের কারণে কোনও কর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে বরখাস্ত করে দায় সারে বিমান। কখনও কখনও তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সেসব কমিটি দায়ীদের শনাক্ত করতে পারেনি। তবে, এসব তদন্ত প্রতিবেদনে বিমানের ক্যাটারিং সার্ভিস ও প্রকৌশল বিভাগের কর্মীরা জড়িত বলেই উল্লেখ করা হয়।
গত শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) এক অনুষ্ঠানে বিমানে সোনা চোরাচালান রোধে নির্দেশে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এক সময় ঠাট্টা করে বলতাম, বিমান স্বর্ণ প্রসবিনী হয়ে গেছে। বিমানে খালি সোনার বারই পাওয়া যায়। ভালোই তো আমাদের সোনার রিজার্ভ বেড়ে যাচ্ছে। আর তো কিছু হচ্ছে না। এগুলোও বন্ধ করতে হবে। যেন বিমানের সুনাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাড়ে।’
সূত্র জানায়, বিমানব্ন্দরে বিমানের বিভিন্ন স্থাপনায় পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা নেই। অন্যদিকে, যে সব জায়গায় আছে সেখানে যথাযথ মনিটরিং করা হয় না। উড়োজাহাজ, হ্যাঙ্গার, কার্গো হাউসে বিমানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী নেই, একইসঙ্গে যারা আছেন, তারাও যথাযথ নজরদারি করেন না। উড়োজাহাজ থেকে কাজ সেরে নামার পর বিমানকর্মীদের সব সময় দেহ তল্লাশি করা হয় না।
চোরাচালান ঠেকাতে বিমানে নজরদারি বাড়ানো ও কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, ‘বিমানের কর্মীরা অফিসে আসা-যাওয়া, উড়োজাহাজে ওঠার সময় নিরাপত্তাকর্মীরা প্রতিনিয়ত তল্লাশি করলেই অনেক ক্ষেত্রে চোরাচালান কমে আসবে। একইসঙ্গে প্রতিটি জায়গায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও নজরদারি বাড়লেও চোরাচালানে যুক্ত হওয়ার প্রবণতাও কমবে। কিন্তু পরিস্থিতি থেকে মনে হচ্ছে, চোরা চালানে সহায়তার করার উদ্দেশ্যেই বিমানের ঊর্ধ্বতন কেউ কেউ এসব বিষয় এড়িয়ে যান।’
সর্বশেষ গত ২৮ ডিসেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে ৬৪ কেজি সোনা উদ্ধার করেছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। কাঠের চারটি ক্যারেটের কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে রাখা সোনার বার পাওয়া যায়। এই সোনাগুলো ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি০৮৫ ফ্লাইটে ঢাকায় আসে। কাস্টমস কর্মকর্তাররা প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করছেন, এ ঘটনায় বিমানকর্মীরা জড়িত থাকতে পারেন।
এর আগে, গত ২৩ নভেম্বর ৭ কেজি ১৯০ গ্রাম সোনাসহ বিমানকর্মীকে আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একইসঙ্গে বিমানটিও জব্দ করা হয়। সেদিন দুবাই থেকে আসা বিামনের ফ্লাইটে (বিজি০৪৮) সিটের নিচে রাখা ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম সোনার বার পাওয়া যায়। অন্যদিকে, একই দিনে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের বহিরাংশ সংলগ্ন রানওয়ে এলাকায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টেকনিক্যাল হেলপার মেহেদি হাসানের কাছ থেকে ২ কেজি ৫৫০ গ্রাম সোনা পাওয়া গেছে।
গত ১৩ নভেম্বর আবুধাবি থেকে আসা বিমানের একটি উড়োজাহাজ থেকে ৮ কেজি ৮০০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। উড়োজাহাজটির সিটের নিচের পাইপের মধ্যে এসব সোনা লুকানো ছিল। এঘটনায়ও উড়োজাহাজটি জব্দ করে ঢাকা কাস্টমস হাউস।
এর আগে, গত ১৩ জুলাই শাহজালাল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার গেটের কাছ থেকে বিমানের ট্রাফিক হেল্পার এমদাদ হোসেন চৌধুরী ও তার সহযোগী আব্দুর রহিমকে ৪ কেজি সোনাসহ আটক করেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের সদস্যরা। তারা দুজনই সেদিন আমদানি কার্গোতে একটি প্যালেট থেকে এসব সোনা নিজেদের হেফাজতে নেন।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে সোনা চোরাচালানের দায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একই সঙ্গে চোরাচালানের পণ্য বহনের দায়ে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ (এস২-এএইচভি) ময়ূরপঙ্খীকে বাজেয়াপ্তও করে কাস্টমস। তবে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে উড়োজাহাজটি অবমুক্তির সুযোগ দিয়েছিল কাস্টমস। এই চোরাচালানের ঘটনায় বিমানকে কারণ দর্শানোর নোটিশের পাশাপাশি ৪ দফা শুনানিতে অংশ নিতে চিঠি দেয় ঢাকা কাস্টম হাউস। বিমানের পক্ষ থেকে নোটিশের জবাব ও একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। তবে কোনও শুনানিতে অংশ নেয়নি বিমান। দায়ীদের শনাক্ত না করেই একটি তদন্ত প্রতিবেদন কাস্টমস হাউসে জমা দেয় বিমান।
এই প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যেসব বিমানের যে সব জায়গা থেকে সোনা উদ্ধার হয়, সেখানে দক্ষ লোক ছাড়া রাখা ও বের করা সম্ভব নয়। একইসঙ্গে বিমানবন্দরের যে জায়গা থেকে উদ্ধার হয়, সেখানেও সাধারণ যেকোনও মানুষের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে এটি পরিষ্কার, যারা বিমানে কাজ করছেন, তাদের কেউ কেউ এ কাজে জড়িত। বিমান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কাস্টমস পুলিশ অনেক সময় নমনীয় থাকে, এ সুবিধাটিও নেয় চোরাকারবারিরা।’
চোরাচালানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, চোরাচালানে প্রতিরোধ কাস্টমস হাউস সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। যেকোনও ধরনের চোরাচালান প্রতিরোধ করতে আমরা কাজ করছি। চোরাচালানের ঘটনা ঘটলে মামলা হচ্ছে, তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোকাব্বির হোসেন বলেন, ‘উড়োজাহাজ বিদেশ থেকে যখন আসে, তখন সেখানে বিমানকর্মীদের উড়োজাহাজের ভেতরে সোনা রাখার সুযোগ নেই। কারণ বিদেশে বিমানের প্রকৌশলসহ অন্যান্য কাজে যে দেশে যায়, সেদেশের কোনও সংস্থার সহায়তা নেওয়া হয়। তবে যখন চোরাচালানে বিমান কোনও কর্মীকে আটক করে, তখন আমরা বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন। সূত্র-বাংলা ট্রিবিউন