সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকার বেশি ঋণ নিয়ে গেলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের শিল্প বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।
সূত্রমতে, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতি বাজেটের আকার ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশি ও বিদেশি ঋণ নিয়ে এ ঘাটতি পূরণ করা হবে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঘাটতি পূরণে আগামী অর্থবছরে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যায় থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার অংক ৯৩ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ ঋণ সংগ্রহের জন্য অর্থ বিভাগ প্রাধান্য দিচ্ছে স্বল্প সুদ ও মুনাফার নতুন নতুন ক্ষেত্র যুক্ত করা। পাশাপাশি আর্থিক খাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের ফলে অর্জিত দক্ষতার মাধ্যমে সরকারের অন্যান্য কার্মকাণ্ডে অর্থায়ন করা।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আসন্ন বাজেটে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে এটি ভালো উদ্যোগ। কারণ এটি সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঋণ। এর সুদের হার সব ঋণের চেয়ে বেশি। সে কারণেই ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। তবে বাজেটে যে অর্থ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় বছর শেষে তা পুরোপুরি খরচ হয় না। ফলে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পুরো ঋণ ব্যবহার হয় না। কিন্তু এরপরও ব্যাংক ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সেটি পুরোপুরি নেওয়া হলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমবে। সেটি হলে বেসরকারি বিনিয়োগ ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ মঙ্গলবার বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণের প্রয়োজন আছে। তবে ঋণ গ্রহণের সময় কম সুদে যেখানে পাওয়া যায় সেটি দেখতে হবে। পাশাপাশি কোন প্রকল্পের জন্য, কেন ঋণ নিচ্ছি এগুলো এখন বুঝতে হবে। যেন সমস্যায় পড়তে না হয়।’
সূত্র আরও জানায়, আগামী বছর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে বিনিয়োগ। প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে ১৩ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্য ১০ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৯১ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন। কিন্তু সরকার নিজেই ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ গ্রহণ করলে নির্ঘাত বেসরকারি খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। বিনিয়োগের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা নিয়েও সংশয় থাকবে।
এদিকে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা আগামী বছরে বাড়ছে শুধু তাই নয়, চলতি অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার বেশি ঋণ নিতে যাচ্ছে সরকার। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের শেষ দিকে এসে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা বেশি নেওয়া হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, শ্রীলংকার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে বড় অংকের বিদেশি ঋণ গ্রহণ। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ঋণ গ্রহণ প্রসঙ্গে সতর্ক অবস্থানে আছে। তার মতে, চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ঋণ নেওয়া হচ্ছে। বছরের শুরুতে বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। এটি কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮০ হাজার ২১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমছে ৩২ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। তিনি আরও বলেন, আগামী বছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কম নেওয়া হবে। কারণ সঞ্চয়পত্রের ঋণের বিপরীতে সরকারকে বেশি মাত্রা সুদ পরিশোধ করতে হয়। একই ঋণ ব্যাংক থেকে নেওয়া হলে সুদ কম গুনতে হবে। যে কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে।