অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাজারের অবদান সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেন, একটি দেশের অর্থনীতির বড় প্যারামিটার হলো পুঁজিবাজার। আমাদের দেশের পুঁজিবাজার গত দুই বছর আগে করোনার মধ্যে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ ছিলো। পুঁজিবাজার এভাবে বন্ধ থাকা যেকোন দেশের জন্য একটি অশনিসংকেত। কিন্ত পরবর্তীতে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশন আসার পরে বাজার ঘুরে দাড়িয়েছিলো। নতুন কমিশন কিছু যুগপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেই সময়। যার ফলে তখন পুঁজিবাজার আবার ঘুরে দাড়ায়। গত কয়েক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনীতির আকারের তুলনায় পুঁজিবাজার এখনো অনেক ছোট। এই বাজারের বিকাশে এখনো অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পুঁজিবাজারে চাঙ্গা থাকলে বিদেশিরা ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টও করতে পারে এবং পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্টও তারা করে। সামগ্রীকভাবে একটি দেশের অর্থনীতিতে জিডিপির এবং তার যে গ্রোথ এটা নিশ্চিত করার মধ্যমেই অর্থনীতি এগিয়ে চলে। রবি, ওয়ালটন হাইটেক এবং বেশ কিছু ভালো ইন্সুরেন্স কোম্পানি বাজারে আসার কারণে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ভালো কোম্পানিগুলো বাজারে আসার ফলে দেশের পুঁজিবাজারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও পুঁজিবাজারকে সচল রাখা এবং মার্কেটের ক্যাপিটালাইজেশন বাড়ানোর পক্ষেও মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করা হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নে পুঁজিবাজার প্যারামিটার হিসেবে কাজ করে। পুঁজিবাজার থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে আরও বেশি দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়ন করতে পারে সেই লক্ষ্যে কমিশন কাজ করছে। নতুন নতুন বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট আনার জন্য আমরা কাজ করছি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ের জন্য গত দুই বছরে পুঁজিবাজারে অনেকগুলো বন্ড অনুমোদ করা হয়েছে। এছাড়া কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে। দেশের উন্নয়নে পুঁজিবাজারের অবদান ভবিষ্যতে আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে কমিশন কাজ করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
একটি দেশের শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি সরবরাহে পুঁজিবাজার বড় অবদান রাখতে পারে। এছাড়া অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বজায় রাখতে শক্তিশালী পুঁজিবাজারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পুঁজিবাজারে বড় কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য মালিকানার কিছু অংশ বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে। একইভাবে শেয়ার কিনে বড় কোনো কোম্পানির ক্ষুদ্র বা বৃহৎ মালিকানার অংশ পায় সাধারণ মানুষ। পরবর্তীতে কোম্পানির উপার্জিত আয় লভ্যাংশ আকারে শেয়ারহোল্ডাররা পেয়ে থাকে। এভাবেই সাধারণ জনগণ তাদের জমানো অলস অর্থ দিয়ে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে তাদের পছন্দমতো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে নিজের ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশের পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০২০ সালের মে মাসে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের দায়িত্ব পাওয়ার পর। দীর্ঘদিন পর আইনের শাসন এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করায় শেয়ারাবাজারের প্রতি ক্রমান্বয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করে। যা করোনার অভিঘাত কাটিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বের সেরা উত্থানের তালিকায় উঠে আসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। এই সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ডিএসই’র ইতিহাসে সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে প্রথম ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে।
দেশের পুঁজিবাজারে ৩৩টি ব্যাংক, ৫৩টি বীমা কোম্পানি, ৩৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড, পোশাক খাতের ৫৮টি কোম্পানি এবং ২২২টি ট্রেজারি বন্ডসহ মোট ৬২৩টি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত। ফলে ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকায়। এতে একদিকে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে মানুষের অংশগ্রহণ যেমন বাড়ছে, তেমনি লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম বাড়ছে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা বর্ণনা করছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ সামাজিক বিভিন্ন সূচকেও উন্নতি করেছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত ২০ বছর ধরে উল্লেখযোগ্য সাফল্য ধরে রেখেছে।পুঁজিবাজারকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব। অনেক সময় দেশের উন্নয়ন হলে পুঁজিবাজারেরও উন্নয়ন হয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে তেমন কোনো অবকাঠামো ছিল না। স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর নয়টি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৬ সালের ১৬ আগস্ট যাত্রা শুরু হয় পুঁজিবাজারের। তবে সর্বপ্রথম ১৯৫৪ সালের ২৪ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ নামে যাত্রা শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির। এরপর নাম পরিবর্তন করে ১৯৬৪ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) নামে পথচলা শুরু করে এটি।
এরপরে ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ডিএসইতে ডিএসইএক্স ও ডিএস-৩০ সূচক যোগ করা হয়। পুঁজিবাজার আরও জনপ্রিয় করতে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা ওয়েবসাইট চালু হয়। একই বছরের ২১ নভেম্বর শুরু হয় ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি ডিএসইতে শরীয়াহ সূচকের যাত্রা শুরু হয়। লেনদেন আরও সহজ করতে ২০১৫ সালে ডিএসই মোবাইল অ্যাপ চালু করে। এর মাধ্যমে ঘরে বসেই লেনদেন করার সুযোগ পার বিনিয়োগকারীরা।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাজারটির আকার ছিল খুবই ছোট। ১৯৯০ এর পর দেশে কলকারখানা চালু হতে থাকে। উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন হয় অর্থের। তারা ব্যাংক ঋণের বিপরীতে বিনা সুদে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও পরিচালনা করতে থাকেন। এরপর বাজারটি সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে ১৯৯৩ সালে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন করা হয়। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নামে পরিচিতি পায়। শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য গঠিত কমিশনের দুই বছর পর ১৯৯৫ সালে প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাজার গঠনের লক্ষ্যে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আরও একটি পুঁজিবাজার গঠন করা হয়। যার নাম রাখা হয় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)।
এরপর মানুষ বাজারমুখী হতে শুরু করে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় ১৯৯৬ সালের পুঁজিবাজারের ধস। কারসাজি চক্রের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে শুরু হয় তদন্ত। বেশকিছু সংস্কারও আনা হয়। ১৯৯৮ সালের ১০ আগস্ট চালু হয় অটোমেটিক ট্রেডিং। কাগজের শেয়ার থেকে ডিমেট শেয়ারে রূপান্তর করতে ২০০৪ সালে ২৪ জানুয়ারি সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) গঠন করা হয়। ওই বছরই যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্বের অন্যান্য পুঁজিবাজারের মতো বৈচিত্র্য আনতে ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি সরকারি বন্ড মার্কেট চালু করা হয়। ২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল সরাসরি তালিকাভুক্তির নিয়মও চালু হয় পুঁজিবাজারে। এরপর তত্তাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। ওই সময় অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। আবারও চাঙা হতে শুরু করে বাজার। এটি এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে ২০১০ সালে নতুন করে আইপিও বুক বিল্ডিং পদ্ধতি চালু করা হয়। এরপর আরেক দফা ধস নামে পুঁজিবাজারে।
অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় আর্থিক খাতের যখন নাজুক অবস্থা তখন একমাত্র আশার আলো পুঁজিবাজার। বর্তমান কমিশন, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটিসহ (বিডা) সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে ব্র্যান্ডিং করতে রোড শোর আয়োজন করে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের সম্ভাবনা তুলে ধরছে। এ সব কার্যক্রমের ফলে করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও দেশের শেয়ারবাজারে মানুষের আস্থা ফিরেছে। বিনিয়োগ বাড়ছে।