ড. আফজাল হোসেন খান চাঁদপুর জেলার মতলব থানায় জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলে পড়াকালীন তিনি ছড়া কবিতা, গল্প লিখতেন। স্কুল পাশ করতেই প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত উপন্যাস ‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ’, অতপর প্রকশিত হয় ‘ঘর পালানো মেয়ে, শ্রাবনী সহ অসংখ্য উপন্যাস ও কবিতার বই ‘এই মেয়ে’। তিনি ২০০৩ সালে শান্ত-মরিয়ম ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতায় যোগ দেন। তখন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য পড়াতে গিয়ে দেখলেন শিক্ষার্থীর সে সময়ের সাহিত্য ইউসুফ জুলেখা, শ্রী কৃষ্ণকীর্তণ কাব্য বুঝতে কষ্ট হয়। তখন তিনি এইসব সাহিত্যগুলোকে গদ্যে গল্পে-উপন্যাসে রূপান্তর করেন, যেন ছাত্ররা বুঝতে পারেন। বই দুটোর নাম রাধা কৃষ্ণ ও ইউসুফ জুলেখা।
এছাড়াও জাতীয় কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে লিখেন ‘নজরুল জীবন কথা’। উপরোক্ত গ্রন্থগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। এভাবেই তিনি হযরত সোলায়মান শাহর জীবনী নিয়ে লেখেন দোহাই লেংটা, এবং লিখেছেন শেখ হাবিবর রহমান সাহিত্য রচনা ও তাঁর অবদান নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই তিনি নানাদিকে বিচরণ করেন সংগ্রহ করতে থাকেন বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও বিয়ের বৈচিত্রময় তথ্য। এইসব নিযে লিখেন ‘বিয়ে’ নামক গ্রন্থ। হাজার বছরের বাংলার লোকসংস্কৃতি-লোকখেলা বিশেষ করে সন তারিখ নিয়ে লিখেন ‘বৈশাখ’ নামক গ্রন্থ। তিনি সকল ধনি-গরিব, ধর্ম-বর্ণ-জাত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিখেন ‘কৃষ্ণমোহাম্মদ’ নামক আলোচিত এক উপন্যাস।
মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজ সংস্কারক পিতার কাছে শৈশব থেকেই মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর বৈচিত্রময় ট্রাজেডির গল্প ও আদর্শের কথা শুনে শুনে বেড়ে উঠেছেন তিনি। সময় পেলেই পড়েছেন নানাগ্রন্থ, ছুটেছেন নানা জনের কাছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার জন্য, যতোই জেনেছেন ততোই অবাক হয়েছেন আর ভাবছেন এই প্রজন্মতো কিছুই জানেননা এতো বড় সাহসের গল্প। এই ‘সাহস’কে তেজ কে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সকল মানুষের কাছে পৌছাতে হবে। এই ভেবে ভেবে দীর্ঘ সাত বছর নিরলস পরিশ্রম করে তিনি রচনা করলেন বঙ্গবন্ধুর জীবন আর্শ নিয়ে উপন্যাস ‘ফাদার অব দ্য নেশন’। গ্রন্থটির প্রকাশে কেঁপে যায় সারা বাংলা। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বইটির মোড়ক উম্মোচনের কথা থাকলেও নিরাপত্তার সমস্যা চিন্তা করে তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আইনবিদ ড. কামাল হোসেন, সেক্টর কমান্ডার কে এম শফিউল্লাহ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ প্রমূখ ও অসংখ্য মিডিয়া ও মানুষের উপস্থিতিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সালে গ্রন্থটির মোড়ক উম্মোচন হয়। গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসব শেষে লেখক বাসায় ফিরতেই পুলিশ তাঁকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফকার করে।
তিনি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তথ্য নিতে গিয়ে তিনি পেয়ে যান একে একে পেয়ে যান বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ ও নিজ হাতে রচিত চিঠিপত্র সংগ্রহের নেশায় মেতে উঠেন। ২০০৭ সালে প্রকাশ করেন ভাষণের প্রথম খণ্ড, অতপর একে একে ২য়, ৩য়, ৪ র্থ খণ্ড প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, একজন কবি বা লেখক তাঁর স্বপ্নের কথা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেন, আর একজন নেতা প্রকাশ করেন পথে-প্রান্তরে-ময়দানে-সবখানে ভাষণের মাধ্যমে, জ্বালাময়ি ভাষণের মাধ্যমেই একটি ঘুমন্ত নিস্পেষিত জাতিকে তিনি জাগিয়েছেন স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কেমন রাষ্ট্র চেয়েছেন, সোনার বাংলা কেমন হবে? কি ভাষণ দিয়েছেন!- যার জন্য ত্রিশলক্ষ মানুষ বুক পেতে দিয়েছিল মেশিনগানের সামনে। ভাষণগুলো না শুনলে না পড়লে বঙ্গবন্ধুকে জানা যাবেনা। তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা, সকল দিক নির্দেশনা ভাষনের মাধ্যমে দিয়ে গেছেন।
ড. খান বছরের পর বছর নানাভাবে নানাস্থান থেকে ভাষণগুলো সংগ্রহ করে মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা খুব ভালো লিখেন। তার লেখাগুলো ড. খান বিভিন্ন পত্রিকা থেকে নানাসময় সংগ্রহ করছেন। তত্বাবধায়কের সরকারের ঈর্ষান্বিত লোভের কারণে প্রিয় নেতৃকে বন্দি করে রাখা হয় প্রায় ২ বছর। সে সময় দল বা দলীয় অঙ্গসংগঠনগুলোকেও প্রতিবাদ করতে দেয়নি ভাড়াটিয়া সরকার। তখন ড. খান প্রতিবাদস্বরূপ বই বিশাল আয়োজন করে জনাব আমির হোসেন আমু এমপি ও হাজার হাজার ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর সকল লেখার সংকলন ‘স্মৃতি বড় মধুর, স্মৃতি বড় বেদনার’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। তিনি এখনো প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা ‘নন্দিত নেতৃত্বে’ শেখ হাসিনা শিরোনামে গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তিনি নিয়মিত সম্পাদনা করেন ‘বং’ নামের বিশেষ সংখ্যা। তাঁর রচিত, সংকলিত ও সম্পাদিত প্রকাশনার সংখ্যা প্রায় ৪০ টিরও বেশী।
তিনি বাংলাদেশ কালচারাল ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সংগঠনের নিয়মিত আড্ডা হতো ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তিনি ভাবলেন এই পার্কেই ৭ মার্চের ঘোষণা, এই পার্কেই জিন্নাহ বলেছে উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই পার্কেই শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়েছে। এই পার্কেই পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেছিল। এই খানেই ১০জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছেন। অসংখ্য স্মৃতিময় ঐতিহাসিক স্থানগুলোর কোনো চিহ্ন নেই। এইসব স্থানগুলো চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণের লক্ষে সংগঠনের ব্যানারে ২০০৫ সালে রিপোর্টাস ইউনিটিতে ‘৬টি দাবী পেশ করেন এবং ক্রমান্বয়ে দাবী জানিয়ে যান। ২০০৮ সালে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ও অধ্যাপক মুনতাসির মামুন এইসব দাবী নিয়ে মামলা করেন। ২০১৩ সালে বিচারপতি খায়রুল হক এবং মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এর রায় দেন।
ড. খান বলেন, ‘এই সেই জায়গা, যেখান থেকে স্বাধীনতার ডাক দেয়া হয়েছিল। এইখানেই তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। এই উদ্যানের মাটির মতো পবিত্র মাটি আর হতে পারেনা। তিনি উদ্যোগী হয়ে এই উদ্যানে সংগঠনের ব্যানারে বিজয় মেলা চালু করেন। দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ জনাব আমির হোসেন আমু , মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, ড. হাসান মাহমুদ, প্রমূখসহ সেক্টর কমান্ডার, ভাষাসৈনিকরা নিয়মিত এসেছেন। তিনি চেষ্টা করছেন রাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে একযোগে ৬৪ জেলায় বিজয়মেলা চলবে মাসব্যাপী। বিজয়ের আনন্দ যুগ যুগ ধরে উপভোগ করবে। তিনি ভাষা সৈনিক, সেক্টর কমান্ডার, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীদের নিয়ে তৈরি করেছেন অসংখ্য তথ্যচিত্র।
আমরা জানি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তেমন কোর্স ছিলো না এবং বাংলায় লেকচার নিষিদ্ধের মতো ছিল। ড. খান ভাষাসৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করেন, ভাষা আন্দোলনের যাদুঘরের সহযোগিতা নিয়ে ইউজিসিকে চিঠি দেন এবং চেয়ারম্যানের সাথে বৈঠক করে ‘বাংলা’ চালুর দাবী জানান। সেই থেকে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়ানো হয়।
তিনি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সকলকে অবহিত করার লক্ষে ‘বঙ্গবন্ধু জীবন-রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ৬ মাসের সার্টিফিকেট কোর্সের ডিজাইন করেছেন। দলীয় সকল সস্য এবং শিক্ষার্থীরা কোর্সটি ফ্রিতে করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই কোর্সটি চালু হবে। সৃজনশীল মানুষটি কখনো অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রে, কখনো টেলিফিল্মে, কখনো নাটকে। তিনটি একক অ্যালবামসহ অসংখ্য অ্যালবামে গান লিখেছেন এমনকী গ্রিন ইউনিভার্সিটির থিম গানটি তার লেখা।
অসংখ্য লেখার ভীড়েও ড. খান বারবার ফিরে আসেন আলোচনায়। তাঁর লেখা বই আজ দেশ-বিদেশের সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যে কেউ এখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করতে গেলেই যেনো তাঁর বই ছাড়া হয়না। তাছাড়া আমরা দেখেছি ২০০৫ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বইমেলায় উনার বই ছাড়া বঙ্গবন্ধুর তেমন বই ছিলনা বললেই চলে। এমনকী ২০০৯ থেকে আজো পর্যন্ত মেলার প্রায় স্টলই সাজানো থাকে তার লেখা নানান বই।
বই অবলম্বনে রচিত হয়েছে নাটক ‘শেখ মুজিব’, রচিত হয়েছে যাত্রাপালা ‘বাংলার মহানায়ক’ । পালাটি দেশের নানাপ্রান্তে গ্রামে-গঞ্জে চলছে। পালাটি দেখতে এসেছেন জনাব ওবায়দুল কাদের. গওহর রিজভী, মামুনুর রশিদ’ আতাউর রহমানসহ অনেকে। গত নির্বাচনে আওয়ামলীগ প্রচরণার জন্য পালাটি সর্বত্র ব্যবহার হয়েছিল। গ্রন্থটি অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে গান বাউল সম্রাট আক্কাস দেওয়ানের সূরে ও মমতাজের গায়কীতে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যতো নাটক, সিনেমা যাই তৈরি হউক না কেন এই গ্রন্থ ছাড়া যেনো অসম্ভব। গ্রন্থটি একটি উপন্যাস, যেনো বঙ্গবন্ধুর জীবনেরই ছায়া। গ্রন্থটিতে গল্পেরও কমতি নেই, ইতিহাসেরও কমতি নেই। লেখকের যাদুকরি মায়াময় নৈপুন্যতারই প্রকাশ এই গ্রন্থে। গ্রন্থটি সম্প্রতি বিশ্বের অন্যতম অনলাইন প্লাটফর্ম অ্যামাজনে প্রকাশিত হওয়ায়, গ্রন্থটি যেনো বিশ্বের সকল ভাষাভাষি, সকল জাতিগোষ্ঠির মানুষের হাতের নাগালে চলে গেল। জাতির পিতার বর্ণাঢ্যময় জীবন ও ট্রাজেডির কথা সকল মানুষ জানতে পারবে এবং তাঁর আদর্শের আলোকে আলোকিত হতে পারবে।
এতো এতো কাজের এই মানুষটি সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখেন। বইয়ে- পত্রিকায় লিখেন ছদ্মনামে। অনুষ্ঠানে সভা-সমিতি থেকে থাকেন দূরে। এমনকী টিভি-রেডিও-পত্রিকায় ইন্টারভিউ এড়িয়ে চলেন। তাঁর কাছের মানুষরে, এমনকী পরিবার-পরিজনরাও তাঁর ব্যাপক কর্মযজ্ঞের কথা জানেন না। তবে সকলের সাথে হাসি-খুশি ও প্রাণবন্তভাবে মিশতে পছন্দ করেন। একজন সদালাপি সুন্দর মনের মানুষ ড. আফজাল হোসেন খান।