জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না তা কিন্তু নয়।
আলী আজম বলেন, ‘আমার জানা মতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আইনগত কোনো বাধা নেই। এ বিষয়ে বিশদ আইন-কানুন, বিধিবিধান আমরা আরও খতিয়ে দেখব।’
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ—ডিএসই, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ-সিএসই বলছে, বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকই তার কর দেওয়া অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবেন। সুতরাং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও পারবেন।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতিকে ব্যাহত করার জন্য অমূলক তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা পুঁজিবাজার আমাদের অর্থনীতিকে আরও অনেক ইতিবাচকভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে। তাই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা সমীচীন নয়।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন—বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের যেকোনো বৈধ নাগরিক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। সরকারি-বেসরকারি আধা-সরকারি অথবা যেকোনো সাধারণ নাগরিকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে কোনো আইনগত বাধা নেই।
একই মত দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব শেখ ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তার বৈধ ও আইকর দেওয়া অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। এখানে আইনগত কোনো বাধা নেই।’
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মশিউর রহমান বলেন, ‘সরকারি নিয়মকানুন বিধিবিধানে যা আছে এর বাইরে আমরা যাব না। আমরা আইন কানুন খতিয়ে দেখেই চলব।’
পুঁজিবাজারে সরকারি কর্মকর্তাদের বিনিয়োগ করা একটি অনুমোদিত বিষয় বলেই জানাচ্ছেন সাবেক নৌপরিবহন সচিব শফিক আলম মেহেদি। তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে কোনো বাধা নেই। এটা অনুমোদিত। সচিবালয়, ডিফেন্স, পুলিশসহ যারাই আছেন সবাই বিনিয়োগ করতে পারবে।’
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবেন না, এমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। তারা চাইলে পুঁজিবাজারে নিজেদের নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। সেখানে নিয়মিত লেনদেনও করতে পারবেন। এছাড়া পরিবারের সদস্যদের নামেও বিনিয়োগে কোনো বাধা নেই।
বাংলাদেশের সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মাসুদ আহমেদ মনে করেন, আইনে বাধা না থাকায় যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী চাইলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি কর্মঘণ্টার ক্ষতি না করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে যুক্ত হন, তাহলে এখানে ক্ষতির কিছু নেই।’
সাবেক এই সিএজি বরং বলছেন, পুঁজিবাজারে তাদের বিনিয়োগ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ভালো। বিচক্ষণ ও দক্ষ বিনিয়োগকারী বাড়লে পুঁজিবাজার আরও সমৃদ্ধ হবে। কারণ সরকারি চাকরিজীবীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের চেয়ে বিচক্ষণ ও দক্ষ। তাই তারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে ভালো ফলই মিলবে।
সমবায় অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. আহসান কবীর বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা কী করতে পারবেন আর কী করতে পারবেন না সেটা চাকরি ও শৃঙ্খলা বিধিমালায় (২০১৮) উল্লেখ আছে। সেখানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না এমন কোনো কথা উল্লেখ নেই। এই অনুযায়ী যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী তার কর দেওয়া অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন তাহলে তাকে নেতিবাচক কিছু বলার সুযোগও নেই।’
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সাবেক সচিব রেজাউল আহসান বলেন, ‘আমার জানামতে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবেন না এমন কোনো বিধিনিষেধ নেই।’
সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে কোনো বাধা নেই বরং এটা অনুমোদিত বলে জানান ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশিদ লালী। সচিবালয়, ডিফেন্স, পুলিশসহ সরকারের সব সংস্থার কর্মচারীরা বিনিয়োগ করতে পারবেন। সবার একটা ভবিষ্যত আছে। বিনিয়োগ না করলে তার ভবিষ্যত কী হবে? এসব বুঝেই সরকার এটাকে অনুমতি দিয়েছে।’
আহমেদ রশিদ লালী বলেন, ‘খুব সম্ভবত ২০১২ সালের দিকে সরকারি কর্মকর্তারা যে বিনিয়োগ করতে পারবে এই নির্দেশনাটা তুলে দেয়ার একটা পায়তারা করেছিলো। তারপর প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন এটা বাতিল করা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আর এটা বাতিল হয়নি। তাই আমি বলব উনারা পুঁজিবাজারে আরও বেশি বেশি বিনিয়োগ করবেন। শুধু পুঁজিবাজারই নয় সরকারি চাকরিজীবীরা এফডিআর করবে, সঞ্চয়পত্র করবে। সকল ধরনের বিনিয়োগ উনারা করবে।’
ডিএসইর সাবেক এ ভাইস প্রেসিডেন্ট আরও বলছেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী চাইলেই কিন্তু আলু পেঁয়াজের ব্যবসা করতে পারেন না। তাহলে উনারা করবেন কী? তাই উনারা অবশ্যই বিনিয়োগ করবে এবং আমি জোর দিয়ে বলব যেন আরো বেশি বিনিয়োগ করেন।
পুঁজিবাজারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি পরিপত্র জারি করেছিলেন সরকার। সেটি প্রায় নয় বছর আগে। অবশ্য কয়েক ঘণ্টার পরেই মৌখিকভাবে সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদারের সই করা ওই পরিপত্রে বলা হয়, ‘ফটকা কারবারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনিয়োগ বিধিবহির্ভূত। অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের ব্যবসায় তারা বিনিয়োগ করতে পারেন না।’
তবে ওই পরিপত্র জারির পরপরই পুঁজিবাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ে। তখন ধসের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছিল পুঁজিবাজার। হঠাৎ প্রজ্ঞাপনে সেই ধস আরও প্রবল হয়। ক্ষতি মোকাবিলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের পুঁজিবাজারের লেনদেনও বন্ধ রাখা হয়। পরে মৌখিক আদেশে পরিপত্রটি প্রত্যাহারের কথা জানায় তথ্য অধিদপ্তর।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারের বড় ধসের কারণ খতিয়ে দেখতে সরকার যে কমিটি করেছিল তার প্রধান ছিলেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। কমিটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১১ সালে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে তারা ২৫টি সুপারিশ করেন। একটি সুপারিশে বলা হয়, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রাম এক্সচেঞ্জ, সিডিবিএল, বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ার লেনদেন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। তবে তারা শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবেন। সূত্র: ঢাকা টাইমস