বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) রিট মামলার আইনজীবী আল ফয়সাল সিদ্দিকী এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
হাইকোর্টের ৭ দফা নির্দেশনা হলো-
১. জেলেরা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সুন্দরবনের সংশ্লিষ্ট স্টেশন অফিসে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দিয়ে পাস (অনুমতি) সংগ্রহ করবেন এবং কেবল বৈঠাচালিত নৌকা ও ‘দোন দড়ি’র মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ কাঁকড়া আহরণ করতে পারবেন।
২. কোনও অবস্থাতেই সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত এলাকার খালের ভেতরে কোনও ধরনের ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলার চালানো যাবে না। এ জন্য বন বিভাগসহ সুন্দরবনের অভ্যন্তরে চলাচলকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।
৩. পাস নিয়ে কাঁকড়া আহরণের জন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশের সময় বন বিভাগের স্টেশন অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট নৌকা ও নৌকার লোকদের কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে হবে। যাতে কোনও ধরনের ‘চারু’ (কাঁকড়া ধরার জন্য বাঁশের শলা দ্বারা নির্মিত চাই, যা স্থানীয়ভাবে চারু নামে পরিচিত) ও ‘বিষ’ কিংবা অন্য কোনও বেআইনি জিনিস নিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। এ ক্ষেত্রে দিনের বেলায় তাদের নৌকা পরীক্ষা করে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া সমীচীন হবে।
৪. প্রতিটি নৌকা পাস নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশকালে তাদের জন্য কী কী করণীয় এবং কী করা দণ্ডণীয় সে সম্পর্কিত হ্যান্ডবিল/পোস্টার সরবরাহ করা যেতে পারে।
৫. যেহেতু সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবাহিত নদী ও খালগুলো থেকে মাছ আহরণ করে তা জেলেপল্লী- দুবলা থেকে সংগ্রহ করে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারের মাধ্যমে পরিবহন করে বাজারজাতকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমতি দেওয়া হয়েছে; সেহেতু অনুরূপভাবে বৈঠাচালিত নৌকা দ্বারা কেবল ‘দোন দড়ি’ পদ্ধতিতে কাঁকড়া আহরণ করে তা দুবলা জেলেপল্লীসহ সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অন্য যেকোনও স্বীকৃত স্থানে যেখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকার/ট্রলারের যাতায়াতে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই, সেখান থেকে সংগ্রহ করে দ্রুত বাজারজাতকরণের জন্য নৌকা বা ট্রলারে পরিবহনের অনুমতি দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত ইঞ্জিনচালিত নৌকার/ট্রলারের কাঁকড়া পরিবহনের জন্য সুনির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করতে হবে এবং ওই সব ইঞ্জিনচালিত নৌকা/ট্রলার সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশকালে স্থানীয় স্টেশন অফিস কর্তৃপক্ষ উক্ত নৌকা/ট্রলার কঠোরভাবে পরীক্ষা করে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি দেবে। যেন কোনও ধরনের বেআইনি জিনিস যা সুন্দরবনের জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ধ্বংস করতে পারে, তা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করাতে না পারে।
৬. সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কৃষি বিভাগ, মৎস্য বিভাগ ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়মিতভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় বাজার, ওষুধের দোকানসহ কৃষির জন্য সার, ওষুধ ও বীজ বিক্রির দোকানগুলোতে অনুসন্ধান করতে হবে, যাতে ওই এলাকায় অননুমোদিত কোনও বিষ বিক্রি করা না হয়।
৭. পাস সংগ্রহ করে সুন্দরবন অভ্যন্তরে প্রবেশকালে কিংবা সুন্দরবনে অবস্থানকালে কাঁকড়া জেলেসহ মৎস্য জেলে এবং অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছে কোনোরূপ বেআইনি দ্রব্য পাওয়া গেলে তাদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়া বিষ দিয়ে মাছ শিকার করলে কিংবা চারু পদ্ধতির মাধ্যমে কাঁকড়া শিকার করলে ওই নৌকার সব আরোহীকে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।
আদালত রায়ে আরও বলেন, এক শ্রেণির জেলেরা সুন্দরবন বিভাগ থেকে মাছ আহরণ করার জন্য পাস সংগ্রহ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবাহিত খালগুলোতে বিষ প্রয়োগ করে মাছ আহরণ করে থাকে। ফলে বিষ প্রয়োগ করা খালে সব ধরনের জীববৈচিত্র্যসহ উদ্ভিদ নষ্ট হয়ে যায়। এ রূপ কাজ অত্যন্ত নিকৃষ্ট। এভাবে বিষ প্রয়োগ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মাছ আহরণ করা অব্যাহত থাকলে একসময় সমগ্র সুন্দরবন এলাকা মৎস্যশূন্য হয়ে যাবে এবং সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্যসহ উদ্ভিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।
জানা গেছে, নিবন্ধিত ট্রলারে পশুর নদী ব্যবহার করে দুবলার চর থেকে সব ধরনের মাছ পরিবহনের অনুমতি আছে বন বিভাগের। তবে কাঁকড়া বহনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না। ফলে কাঁকড়া ধরার পর খুলনায় আনতে দেরি হওয়ায় অনেক কাঁকড়া মারা যেত। এ অবস্থায় অন্যদের মতো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় কাঁকড়া পরিবহনের অনুমতি চেয়ে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট প্রধান বন সংরক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন করেন দাকোপ ও বটিয়াঘাটাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার কাঁকড়া আহরণকারী জেলেরা।
কিন্তু বন বিভাগ ওই আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় জেলেরা ২০১৮ সালে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। হাইকোর্ট ৩০ দিনের মধ্যে জেলেদের আবেদন নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন।
এরপর ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর বন বিভাগ আবেদনকারীদের জানায় যে, কাঁকড়া পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হবে না।
পরে বন বিভাগের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে জাহান আলী গাজীসহ ৮ জন ২০১৯ সালে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। আদালতে রিটকারীদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন আল ফয়সাল সিদ্দিকী। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
এর দীর্ঘদিন পর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত তৎকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ।