আমাদের পুঁজিবাজারে শুধুমাত্র ইক্যুইটি প্রোডাক্ট লেনদেন হয়। দু’একটি বন্ড নামকায়াস্থে তালিকাভুক্ত হয়েছে, কিন্তু জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। দীর্ঘ ৪৫ বছর পার হয়ে গেলেও গড়ে উঠেনি আধুনিক পুঁজিবাজার। ফলে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাজারে আসেনি নতুন নতুন প্রোডাক্ট। সম্ভব হয়নি যুগোপযোগী লেনদেন প্ল্যাটফর্ম। এটি করতে না পারাটা নিঃসন্দেহে চরম ব্যর্থতার। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ২৫ লাখ বিও হিসাব যার অধিকাংশ আবার একই ব্যাক্তির একাধিক ব্রোকার হাউসে নিবন্ধিত। হতাশার কথা আজ লিখবো না ! ভালো উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে ও ফাইন্যান্সের একজন ছাত্র হিসাবে নতুন ফাইন্যান্সিয়াল প্রোডাক্টটা নিয়ে কাজ করার আনন্দে আজ লিখতে বসেছি। বন্ড লেনদেন আইন বাস্তবায়ন হলে পণ্য বৈচিত্র্য (Product diversify) সংযোজিত হবে ও দেশে বিনিয়োগের জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মক্ত হবে। কিভাবে তা বলছি :
পারপিচুয়াল বন্ড কী ?
– পারপিচুয়াল শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ চিরস্থায়ী, শাশ্বত, অনন্ত। অর্থাৎ এ বন্ডের নির্দষ্ট কোনো মেয়াদ নেই। ফিক্সড ডিপজিট/ এফডিআর বা সঞ্চয়পত্র মেয়াদান্তে ভাঙাতে হয় বা রিনিউ করতে হয়, এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীকে ওই কাজটি করার আর প্রয়োজন হবে না।
বাৎসরিক আয় :
রেট অফ রিটার্ন হিসাব করলে বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ডিপজিট রেটের তুলনায় বন্ডের রিটার্ন অনেক বেশী হবে। ফিক্সড ডিপজিট যেমন ঝুঁকিমুক্ত বা সীমিত ঝুঁকি; ঠিক তেমনি বন্ডে বিনিয়োগ তুলনামূলক ঝুঁকিমুক্ত রিটার্ন (Risk free return) এবং অধিক হারে। বন্ডের স্বকীয়তার জন্যই এফডিআর এর চাইতে সুদ/ মুনাফার এই হেরফের।
কারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন :
সুদ/ মুনাফার হার বাজারের প্রচলিত হারের চেয়ে বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ থাকবে। যারা ব্যাংকে এফডিআর করে বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তাঁরা তাদের পছন্দের ব্যাংকেই বিনিয়োগ করবেন শুধু ধরনটা পরিবর্তন হয়ে এফডিআর এর স্থলে বন্ডে হবে। একটা ছোট্ট উদাহারন দেই, একজন ব্যক্তি এ -টু জেড ব্যাংকে ৬% সুদে এক বছরের জন্য ১ লক্ষ টাকার একটা এফডিআর করলেন। তিনি ইচ্ছা করলে ঐ একই ব্যাংকের বন্ড কিনলে তাঁর রিটার্ন হবে ১১ -১৪ %। সিম্পল প্রবাসী, Retaired ব্যক্তিগন, গৃহস্থালি সঞ্চয় ও কিছু স্মার্ট মানি এই বিনিয়োগ সুবিধা গ্রহণ করবেই !
এফডিআর রেট থেকে বন্ডের সুদ/ মুনাফার হার বেশী হবে কেন ?
এজাতীয় পারপিচুয়াল বন্ড টিয়ার ১ ক্যাপিটাল (বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যসেল ৩ পরিপালন করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ইক্যুইটি হিসাবে পরিগণিত হবে) হিসাবে চিহ্নিত হবে। Cost of Capital সব সময়ই মূল্যবান/Costly এবং তা লভ্যাংশ হিসাবে পরিগণিত হবে তাই বন্ডের রেট অফ রিটার্ন সবসময় বেশী হবে।
পারপিচুয়াল বন্ডে বর্তমানে বিনিয়োগকারী কারা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাঃ
বর্তমানে পারপিচুয়াল বন্ডে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এবং উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তি বিনিয়োগ করে থাকেন। বর্তমানে প্রতিটি বন্ডের ভ্যলু দশ লক্ষ টাকা। যা ছোট বিনিয়োগকারীদের জন্য দুরহ। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চাচ্ছে এর মূল্যমান কমিয়ে এনে পাঁচ হাজার টাকা “পার ইউনিট” করার। তাহলে এর তারল্য অনেক বাড়বে এবং পুঁজিবজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে এটি সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসবে।
কেন বন্ড ইস্যু করা হয় এবং এর উপযোগঃ
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলতে মূলধনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সাধারণত (এনপিএল) মন্দ ঋণ,বা কূঋণ বেড়ে গেলে তার প্রভিসনিং করার কারনে মূলধনে ঘাটতি দেখা দেয়। মূলধন বাড়ানোর সহজ মাধ্যম হল বোনাস, রাইট ইস্যু করার দ্বারা। যেহেতু তা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্ট কম্পানির আর্থিক সক্ষমতাও লাগবে। এটি না করে সহজভাবে বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে ঐ মূলধন ঘাটতি পুরন করা যায়। এ ছাড়াও ব্যাংক সমুহের ব্যবসা সম্প্রসারনের কারনে ক্যাপিটাল বড় করার প্রয়োজন। আরেকটা সুবিধা হচ্ছে ক্যাপিটাল হিসাবে চিহ্নিত হবে। কিন্তু ক্যাপিটাল ডাইলুসান হবে না বা শেয়ারের সংখ্যা বাড়বে না। যা উদ্যোগতা ও শেয়ারহোল্ডার উভয়ের জন্য ভাল। তাই ব্যাংকগুলো দ্রুততম সময়ে পারপিচুয়াল বন্ড ছেড়ে ঘাটতি পুরন করাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
মূলধন বাজার বনাম বন্ড মার্কেট
এটি সম্পূর্ণরূপে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক লক্ষ্যের উপর নির্ভর করে। যদি তাঁরা বিশাল রিটার্ন আশা করেন এবং ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকেন তবে একটি ইক্যুইটি মার্কেট তাঁদের জন্য দুর্দান্ত বিকল্প। যেখানে ক্যাপিটাল গেইন ও ডিভিডেন্ড ইনকাম দুইভাবে লাভবান হওয়া যায়। অন্যদিকে যে সমস্ত বিনিয়োগকারী অতিরিক্ত সতর্কতার সাথে মূলধনটি সংরক্ষণ করতে পছন্দ করেন তারা Debt / বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগকে পছন্দ করেন। একজন পোর্টফলিও ম্যানেজার হিসাবে আমাদের, সর্বদা পরামর্শ, বিনিয়োগের পূর্বে আপনার লক্ষ্যটি আগে ঠিক করুন।
পোর্টফলিও ব্যবস্থাপনাঃ
উভয় বিনিয়োগের পণ্য থাকার ফলে দুইয়ের সংমিশ্রণে অত্যন্ত চমৎকার পত্রকোষ ব্যবস্থাপনা (Portfolio Management) সম্ভব। বন্ড সমুহের সুদ/ মুনাফা বণ্টন হওয়ার পর তা শেয়ারে বিনিয়োগ করে একই ফান্ডকে একাধিক ম্যনুভারিং করা যায়।
বন্ড বিনিয়োগ ও তারল্য :
এফডিআর বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ মেয়াদান্তের পূর্বে ভাঙ্গালে নির্দিষ্ট হারের চেয়ে কম রিটার্ন পাওয়া যায় এবং পুরো টাকাটা ভাঙ্গাতে হয়। যদিও প্রয়োজন ছিল হয়তো আংশিক। বন্ড বিনিয়োগ প্রয়োজন মাফিক যে কোন সময় বিক্রি করা যায় এবং রেট অফ রিটার্নের হেরফের হয় না।
ইসলামী বন্ড :
ইসলামী ব্যাংকগুলো শারীয়াহ কমপ্লায়েন্স ঠিক রেখে বন্ড ছাড়বে। যারা ইসলামী ব্যাংকসমুহে মুনাফা ভিত্তিক এফডিআর রাখেন তাঁরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বন্ডে টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন। সুদের হার বাড়ার সাথে সাথে বন্ডের দাম হ্রাস পায় যেহেতু সুদের হার এবং বন্ডের দামের মধ্যে একটি বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে। বন্ডের দাম এবং স্টকগুলো সাধারণত একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হয়। ক্রমহ্রাসমান সুদের হার বন্ডের দাম বাড়ায়।বর্তমানে ডিএসইতে ইসলামী ব্যাংকের আইবিবিএল মুদারাবা বন্ড লেনদেন হচ্ছে। ২০১৮ সালে এর রেট অফ রিটার্ন ৯.০২%। সম্প্রতি সিটি, যমুনা, ওয়ান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪০০ কোটি করে মোট ১৬০০ কোটি টাকার পারপিচুয়াল বন্ডের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য ও আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এইসব পণ্যের সুদের হার সর্বনিম্ন ১১% এবং সর্বোচ্চ ১৪% পর্যন্ত যেতে পারে ( ব্যাংক সমুহের ডিপোজিটের সাথে স্প্রেড যোগ করে) !!!
এর ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেকটি ব্যাংক বন্ড ছেড়ে ক্যাপিটাল রিকয়ারমেণ্ট ঠিক করবে। ধারনা করা হচ্ছে আরও অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু হতে পারে। সুতরাং নতুন বিনিয়োগের জন্য বৃহৎ এক Fixed Income Secured Market তৈরি হতে যাচ্ছে।
পরিশেষে একটা আশাবাদ রেখে শেষ করবো। নতুন এই বিনিয়োগ সম্ভাবনা আমাদের পূঁজিবাজারকে অনেক গতিশীল করবে বলে আমি দারুণ আশাবাদী। বিনিয়োগ করার জন্য অপশন থাকবে। স্টক প্রাইস কমতে থাকলে ফিক্সড ইনকাম প্রোডাক্ট এ Swap করার সুযোগ তৈরি হবে।মজার ব্যপার হলো উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ পূঁজিবাজারে থেকে গেল। স্টক থেকে বন্ডে গেল কিন্তু FDR আকারে ব্যাংকে আর গেলো না। সচেতন বিনিয়োগকারি যুক্তসঙ্গত রিটার্ন সাথে সাথে ঝুঁকি মুক্ত বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারবেন। ভবিষ্যৎ বলে দেবে আমরা আসলে কি চাই !!
মেসবাহ উদ্দিন খান (মিঠু)
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)
শেলটেক ব্রোকারেজ