অবশেষে আমদানি-রপ্তানি কমার প্রভাব বোঝা গেল দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে ব্যাপক কড়াকড়ির কারণে বেশ কয়েক মাস ধরেই আমদানি কমার আঁচ করা হচ্ছিল; কিন্তু আগস্ট মাস পর্যন্ত তার প্রভাব বোঝা যায়নি। শেষমেশ সেপ্টেম্বর থেকেই আমদানি ও রপ্তানি দুটিই কমার চিত্র পাওয়া গেল। বিদেশি জাহাজের মেইন লাইন অপারেটরদের হিসাবে, ২০২২ সালের আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে আমদানি কমেছে ১২ শতাংশ আর রপ্তানি কমেছে ১৬ শতাংশ।
দুবাই থেকে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন সমুদ্রবন্দরে পণ্য ট্রেডিং করেন বাংলাদেশি তরুণ ব্যবসায়ী অসীম কুমার দাশ। তিনি বলেন, করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সময়ই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বড় ধরনের বিপাকে ফেলেছে। এখন বিশ্বজুড়েই পণ্যের দাম বেড়েছে; বিপরীতে চাহিদা কমেছে। চাহিদা কমার প্রমাণ পাওয়া যায় সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে ধস নামা। চাহিদামতো পণ্য না থাকায় কনটেইনার পরিবহন ভাড়া ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। যুদ্ধ দ্রুত না থামলে এর ধারাবাহিকতার উন্নতি হবে না।
বিদেশি জাহাজের মেইন লাইন অপারেটরদের হিসাবে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার এসেছে এক লাখ এক হাজার ৪৯৩ একক; আগস্টে এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৯২০ একক। শতাংশের হিসাবে আমদানি কমেছে ১২ শতাংশ। জুলাই মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৬০০ একক।
আমদানি কমার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত মে মাসে ১৩৫ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানির ওপর রাজস্ব বোর্ড নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছে। সেই সঙ্গে এসব পণ্যসহ কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকে শতভাগ মার্জিন দিতে হচ্ছে, অর্থাৎ এক কোটি টাকার ঋণপত্র খুলতে এক কোটি টাকা নগদ দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। সেই সঙ্গে বিদেশে এসব পণ্যের বুকিং দর বেড়ে গেছে; আর দেশে চাহিদা কমে গেছে। সব মিলিয়ে পণ্য আমদানির হার কমেছে।
মেডিটেরানিয়ান শিপিং কম্পানি (এমএসসি) হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসাইন চৌধুরী বলছেন, আমদানি কমার প্রভাব আগে থেকেই ধারণা করছিলাম সেপ্টেম্বর মাসেই এর প্রমাণ পেলাম। ঋণপত্র খুলতে কড়াকড়ি, ডলারের বিনিময়মূল্যে অস্থিরতা এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানি কমেছে। এই ধারা ডিসেম্বর, এমনকি জানুয়ারির শুরু পর্যন্তও থাকতে পারে। এর পর থেকে আশা করছি ধারাবাহিকভাবে উন্নতি হবে।
আর সেপ্টেম্বরে রপ্তানি পণ্যভর্তি কনটেইনার এসেছে ৬৩ হাজার ৮০৩ একক। আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৬৯৭ একক। শতাংশের হিসাবে রপ্তানি কমেছে ১৬ শতাংশ। আর জুলাই মাসে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার ১২৪ একক। অথচ আগস্ট মাস পর্যন্তও আমদানি-রপ্তানির গতি ইতিবাচক ছিল।
এশিয়ান গ্রুপের কর্ণধার ও গার্মেন্ট ব্যবসায়ী এম এ সালাম বলছেন, মন্দাদশার যে আশঙ্কা সেপ্টেম্বরে এসে রপ্তানি চিত্রে তা দেখলাম। রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়া অন্যতম। সেই সঙ্গে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপজুড়ে বিলাসী পণ্যের চেয়ে নিত্যপণ্যের দিকেই নজর বেশি ক্রেতার। অর্থনীতিতে প্রায় মন্দাভাবের কারণে চাহিদা ও ভোগক্ষমতা কমেছে ভোক্তা পর্যায়ে। এর ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের শুরুতে পণ্য অবিক্রীত থাকায় নতুন রপ্তানি আদেশের বিষয়ে তারা সতর্ক। এমনকি অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের রপ্তানি আদেশ স্থগিত রেখেছে। তবে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এক পরিচালক বলছেন, ‘প্রতিবছর সেপ্টেম্বর-নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানির গতি কম থাকে। এবারও তাই হয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ১৪ শতাংশ রপ্তানি বেশি হয়েছে। ২০২০ সাল করোনার কারণে বাদ দিলাম। ২০১৯ সালের চেয়ে এখন বেশি রপ্তানি হয়েছে। আমি আশাবাদী নভেম্বর থেকে আবারও রপ্তানি বাড়তে শুরু করবে। ’