দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একই গ্রুপে তিনটি কোম্পানির মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লোপাট করার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে দুই কোম্পানির সম্পদ নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আরেক কোম্পানির সম্পদও নিলামে বিক্রির জন্য অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব একটি ব্যাংক। এসব কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ শেয়ার রয়েছে। ফলে কোম্পানির কোন সম্পদ বলতে কিছুই নেই। বর্তমানে এসব কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা নাম মাত্র কাগুজে কোম্পানির শেয়ার ধারণ করছেন। মালিকপক্ষ শেয়ারবাজার থেকে অর্থ নিলেও কয়েক যুগ ধরে বিনিয়োগকারীদের কোন লভ্যাংশ দেয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। অর্থসংবাদের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারের ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেট থেকে এটিবি ও এসএমই প্লাটফর্মে লেনদেনের জন্য স্থানান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কোম্পানির শেয়ার এটিবিতে লেনদেনের অপেক্ষায় রয়েছে। কোম্পানিগুলো হলো- শ্রীপুর টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকো এবং আলফা টোব্যাকো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড।
অর্থসংবাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব কোম্পানির অর্থ লোপাট করে মালিকপক্ষ নতুন একাধিক কোম্পানি গঠন করে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছে। একই গ্রুপের তিনটি কোম্পানির অফিসের ঠিকানা একই ভবনে রয়েছে। সরেজমিনে কোম্পানিগুলোর একাধিক কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালানোর প্রমাণ মিলেছে। শেয়ারহোল্ডারদের সাথে প্রতারণা করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে কোম্পানিগুলোর মালিকপক্ষ। অচিরেই এদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বাজার সংশ্লিষ্টরা।
১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ইরবা গ্রুপ লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান শ্রীপুর টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটির ৩৭ দশমিক ১৫ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন। উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে কোম্পানিটির ৫০ শতাংশ শেয়ার। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। শ্রীপুর টেক্সটাইলের শেয়ার সর্বশেষ ৯ টাকা ৫০ পয়সা দরে লেনদেন হয়েছিল।
২০১৪ সালে শ্রীপুর টেক্সটাইল লিমিটেডের কারখানা বিক্রি করে দেয় বাংলাদেশ ডেভলোপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)। বিক্রি করে দেওয়া কারখানাটিই কোম্পানিটির একমাত্র সম্পদ ছিল। ফলে শুধুমাত্র কাগজে-কলমেই কোম্পানির অস্তিত্ব রয়েছে, কোন সম্পদ প্রতিষ্ঠানটির নেই।
ইরবা গ্রুপের একজন কর্মকর্তা অর্থসংবাদকে জানিয়েছিলেন, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক আগেই শ্রীপুর টেক্সটাইলের সম্পদ নিলামে বিক্রি করে দেয় বাংলাদেশ ডেভলোপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)।
তিনি জানান, নিলামে কোম্পানিটির সম্পদ কিনে নেয় ডিভাইন টেক্সটাইল। বর্তমানে ডিভাইন টেক্সটাইলের কারখানা গাজীপুরে।
এছাড়াও ইরবা গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেডের কারখানাও বিক্রি করে দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। এই কোম্পানিরও একমাত্র সম্পদ ছিল নিলামে বিক্রি হওয়া কারখানাটি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকো কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের পরিমাণ ৫৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বাকি ৪৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ শেয়ার কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে। ১৯৮০ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির শেয়ার সর্বশেষ ডিএসইতে ২৪ টাকা ৪০ পয়সা দরে লেনদেন হয়েছিল।
চলতি বছরের জুনে কোম্পানির বর্তমান অবস্থা জানতে চেয়ে বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকোকে চিঠি দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। চিঠিতে কোম্পানির গত পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন তলব করা হয়েছিল।
জানা গেছে, ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশ লিফ টোব্যাকোর উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ২০১২ সালের আগস্ট মাসে কোম্পানিটির কারখানাসহ সব সম্পত্তি আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেডের কাছে হস্তান্তর করে অর্থঋণ আদালত। পরে প্রতিষ্ঠানটির সব সম্পদ নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, ইরবা গ্রুপের আরও একটি কোম্পানি আলফা টোব্যাকো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। এই কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৬ সালে।
জানা গেছে, আলফা টোব্যাকোতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৫২ দশমিক ৪৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। কোম্পানিটির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৩৫ দশমিক ৬০ শতাংশ শেয়ার। এছাড়াও কোম্পানিটিতে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক এবং ৩ দশমিক ২০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের পরিমাণ ২৮ লাখ ৮০ হাজার।
সূত্র জানায়, আলফা টোব্যাকোর কারখানাও নিলামে বিক্রি করার জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইরবা গ্রুপের একজন কর্মকর্তা অর্থসংবাদকে জানান, সোনালী ব্যাংক থেকে আলফা টোব্যাকো সর্বমোট ২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। পরিশোধ করেছে ৯০ কোটি টাকা। তবে সোনালী ব্যাংক ১৫০ কোটি টাকার দাবি করে কোম্পানির একমাত্র সম্পদ কারখানাটি নিলামে বিক্রির জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে।
আলফা টোব্যাকোর ৫৫তম বার্ষিক প্রতিবেদনের একটি কপি অর্থসংবাদের হাতে এসেছে। ২০২১-২১ অর্থবছরের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ৮১ পয়সা লোকসান হয়েছে। এর আগের বছর (২০১৯-২০২০) অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ২ টাকা ৮৩ পয়সা। অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে আলফা টোব্যাকোর লোকসান কমেছে ০২ পয়সা।
এছাড়াও, ৩০ জুন, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত কোম্পানিটির ব্যাংক লোনের পরিমাণ ছিল ৩৫ কোটি ৫ লাখ টাকা। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কোম্পানিটির মোট ৭ কোটি ২৯ লাখ ১৫ হাজার ২৪৮ টাকার সম্পদ ছিল, বিপরীতে দায় ছিল ১০৬ কোটি ৭৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬২ টাকা।
জানা গেছে, আলফা টোব্যাকো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আহমেদ ইউছুফ। মো. ইকবাল সাঈদ এবং মাহতাব উদ্দিন আহমেদ কোম্পানিটির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন।
তিন কোম্পানির সার্বিক বিষয়ে জানার জন্য আলফা টোব্যাকোর কোম্পানি সচিব নাসিমা খাতুনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। এমনকি মুঠোফোনে এসএমএস পাঠানোর পর দুইদিন পার হলেও কোন উত্তর মেলেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, নিয়ম অনুযায়ী, যারা ঋণ দিয়েছে তারা কোম্পানিটির সম্পদ আগে পাবে। ঋণদাতারা নেওয়ার পর কিছু থাকলে তারপর বিনিয়োগকারীরা পাবে, এটাই নিয়ম।
তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা এ ধরণের কোম্পানিকে আইপিওতে আসতে দিয়েছি। এগুলো দেখার কেউ নেই। মাঝখানে আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হয়েছি।
অধ্যাপক আবু আহমেদ মনে করেন, আমাদের দেশের অনেক উদ্যোক্তা ধাপ্পাবাজ, ব্যর্থ। এজন্যই প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, কিছু কোম্পানি আইপিওতে আসার সময় পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে, তারপরও তাঁরা ম্যানেজ করে শেয়ারবাজারে আসছে। প্রতারণারও একটা সীমা আসছে। রেগুলেটর (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) যদি গার্ড (নিরাপত্তা) না দিতে পারে, তাহলে কে দিবে?