রাশিয়ার ‘প্রথম’ হওয়ার তাড়নার সঙ্গে করোনা ভ্যাকসিনের মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। প্রথম দেশ হিসেবে সাফল্যের ঘোষণা দেওয়া রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিনটির নাম রেখেছে ‘স্পুটনিক-৫’! যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সর্বপ্রথম মহাশূন্যে তারা যে স্যাটেলাইট প্রেরণ করে তার নামও ছিল স্পুটনিক।
মহামারি করোনা প্রতিরোধে বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে চেয়েছিল রাশিয়া। তাইতো বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা চালিয়ে নিরাপদ ও কার্যকরিতা ভালোভাবে যাচাই না করেই ভ্যাকসিন ব্যবহারে মস্কোর অনুমোদনকে বিশেষজ্ঞরা ‘বেপরোয়া পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ব্রিটেন ওয়ারউইক বিজনেস স্কুলের বিশেষজ্ঞ ওষুধ গবেষক আয়ফার আলি রয়টার্সকে বলেন, ‘এত দ্রুত ভ্যাকসিন ব্যবহারের এমন অনুমোদনের অর্থ হচ্ছে এর দ্বারা বিরুপ প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এটা বিরল। এ কারণে এই ভ্যাকসিন মারাত্মক ও নেতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে।’
অথচ মঙ্গলবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভ্যাকসিনটির অনুমোদন দিয়ে বলেন, আমরাই প্রথম করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করেছি। আমাদের তৈরি ভ্যাকসিনটি স্থায়ী বা টেকসই প্রতিরোধী সক্ষমতা দেখাতে সক্ষম। প্রয়োজনীয় সব ধাপ অতিক্রম করেই তা কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
মস্কোভিত্তিক গামালেয়া ইনস্টিটিউটের তৈরি ওই ভ্যাকসিনটির কোনো প্রকার বৈজ্ঞানিক ফলাফল কোনো বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়নি। আর এ কারণেই রুশ ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা এবং সুরক্ষা নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যখাতে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ উৎকন্ঠা।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জেনেটিক্স ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সিস বেলাক্স রাশিয়ার ভ্যাকসিন ব্যবহারের এই অনুমোদনকে ‘বেপরোয়া ও বোকামি সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরিক্ষা না করেই গণহারে মানুষের জন্য ভ্যাকসিন ব্যবহারের এমন অনুমোদন অনৈতিক।’
ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের ইমিউনোলোজির অধ্যাপক ড্যানি আল্টম্যান বলেন, ‘নিরাপদ ও কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি, এমন কোনো ভ্যাকসিন মানুষের ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়ায় ভ্যাকসিনের কল্যাণে মানুষ যতটা উপকৃত হওয়ার কথা ছিল সমান্তরালভাবে ঠিক ততটাই ক্ষতি হবে।’
করোনার সম্ভাব্য একটি ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের সঙ্গে যুক্ত জার্মানির ইউনিভার্সিটি হসপিটালের বিশেষজ্ঞ পিটার ক্রেমসনারও মস্কোর তৈরি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তড়িঘড়ি করে দেশটির ভ্যাকসিন ব্যবহারের এমন অনুমোদনের বিষয়টিকে ‘বেপরোয়া’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কোনো ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার পূর্বে আপনাকে অবশ্যই বৃহৎ পরিসরে মানবদেহে প্রয়োগ করার মাধ্যমে এর সুরক্ষা ও কার্যকারিতা নিশ্চিতে পরীক্ষা চালাতে হবে। আমি মনে করি তারা (রাশিয়া) এটা করেনি।’
নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ ও মহামারি বিশেষজ্ঞ কেইথ নিল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রাশিয়ার তৈরি করোনার ভ্যাকসিন কার্যকর ও নিরাপদ কিনা এটা তো আমরা জানতে পারছি না। কারণ এর বৈজ্ঞানিক ফলাফল তারা কোথাও প্রকাশ করেনি। ফলে এটি নিয়ে সংশয় থাকাটাই তো স্বাভাবিক।’
শুধু বিজ্ঞানী আর বিশেষজ্ঞ নয় স্বাস্থ্য বিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ডব্লিউএইচও রাশিয়ার তৈরি ও অনুমোদন পাওয়া ভ্যাকসিন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেছে, তারা যে ভ্যাকসিন মানুষের ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওই ভ্যাকসিন নিয়ে মূল্যায়ন করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য পায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীভাবে তৈরি হলো, সুরক্ষা সম্পর্কিত তথ্য, রোগ প্রতিরোধে কতটা সক্ষম ছাড়াও আদৌ এই ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঠেকাতে পারে কিনা— এসব বিষয় নিয়ে রাশিয়া বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ না করায়, বিজ্ঞানী, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষ ধোঁয়াশার মধ্যে পড়েছেন।