বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব বলছে, ২০২২ সালে দেশে ৫ লাখ ৭১ হাজার ১৫১ ইউনিট গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছে। এর আগের বছর নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩০ ইউনিট। গত বছর দেশে যত গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছে তার ৮৮ শতাংশই মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল নিবন্ধনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেশে ডলার সংকট দেখা দিলে গাড়ি আমদানিতে শতভাগ মার্জিন নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে একটি গাড়ি আমদানি করতে মূল্যের ৫ শতাংশ পরিশোধ করেই ঋণপত্র খুলতে পারতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু শতভাগ মার্জিন নীতির কারণে গাড়ি আমদানির জন্য এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের মূল্যের পুরোটাই পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বেড়েছে ডলারের দাম। বাড়ানো হয়েছে শুল্ক-কর। ফলে গাড়ির দামও বেড়েছে। আবার গত বছরের ৩ জুলাইয়ের পর থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়ি কেনা বন্ধ রেখেছে। এতকিছুর পরও গত বছর ১৬ হাজার ৬৯৫ ইউনিট গাড়ি (প্রাইভেট কার) নিবন্ধন দিয়েছে বিআরটিএ, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি।
যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নিলে ব্যক্তিগত গাড়ি বিক্রিতে আরো বেশি প্রবৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিল। সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের কারণে প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে ব্যক্তিগত গাড়ি আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সাবেক সভাপতি আব্দুল হক বলেন, ‘২০২২ সালে দেশে ১৬ হাজার ৬৯৫ ইউনিট গাড়ি নিবন্ধন হয়েছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে এটা কোনো সংখ্যা হলো? বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নতি করছে, তাতে দেশের ১০ শতাংশ মানুষের কাছে গাড়ি (প্রাইভেট কার) থাকা উচিত ছিল। কিন্তু এখন দেশের ১ শতাংশ মানুষও গাড়ি ব্যবহার করে না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখলে গত বছর দেশে ব্যক্তিগত গাড়ি বিক্রি ও নিবন্ধন আরো বেশি হওয়া উচিত ছিল। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে হয়তো এটা সম্ভব হয়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘দুই মাস ধরে কোনো এলসি খোলা হচ্ছে না। এ সময়ে দেশে অন্তত ৫ হাজার গাড়ি আমদানি হওয়ার কথা ছিল। এই যে শূন্যতা তৈরি হলো, এটা কিন্তু বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এরপর আবার বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে আমাদের সাপ্লাই চেইনটা ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। ডলারের কারণে গাড়ির দাম বেড়ে যাচ্ছে। ট্যাক্স বেড়ে যাচ্ছে। এতে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষের কাছে গাড়ি কেনাটা সহজলভ্য হলেও যারা মূল ভোক্তা, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এটা পুরো খাতটির জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০২২ সালে সামগ্রিকভাবে দেশে গাড়ির বাজার তুলনামূলক ভালো ছিল। তবে বছরের প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনৈতিক সংকট এবং বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধের কারণে বাজারটির প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। তাদের দাবি, অর্থনৈতিক সংকট না থাকলে গাড়ির বাজারে আরো বেশি প্রবৃদ্ধি হতো।
শ্রেণীভেদে ২০ ধরনের গাড়ি নিবন্ধন দিয়ে থাকে বিআরটিএ। ২০২২ সালে বিআরটিএ যত গাড়ি নিবন্ধন দিয়েছে তার ৮৮ শতাংশই ছিল মোটরসাইকেল। নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের পরিমাণ ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২ ইউনিট। গত বছরের তুলনায় নিবন্ধনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
অন্যদিকে বাংলাদেশে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হওয়া মোটরসাইকেলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনিবন্ধিত থেকে যায়। অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা হিসাবে আনলে ২০২২ সালে বিক্রি হওয়া মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছয় লাখ ইউনিট ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
গত বছর দেশে মোটরসাইকেলের বাজারে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু সরকারি বিধিনিষেধ এবং সিদ্ধান্ত বাজারের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বিষয়টি সম্পর্কে মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান বলেন, ‘গত বছর মোটরসাইকেলের বাজার খারাপ ছিল না। কিন্তু কিছু কিছু সিদ্ধান্ত মোটরসাইকেলের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল বিক্রি করা যাবে না, এক জেলার মোটরসাইকেল অন্য জেলায় চলতে পারবে না—এমন বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা সরকার বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন হোক আর না হোক তা বাজারটিকে ঠিকই প্রভাবিত করেছে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলতে না দেয়ার সিদ্ধান্তও বাজারে প্রভাব ফেলেছে। স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।’
ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে মোটরসাইকেল রফতানির সম্ভাবনাও এসব বিধিনিষেধের কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ রফতানির ক্ষেত্রে এখন শুধু তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। অটোমোবাইল খাত থেকে যে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আসতে পারে, তার প্রমাণ হচ্ছে ভারত, কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড। আমাদের সেই পথে যেতে হলে কোয়ান্টিটি রেস্ট্রিকশন যাতে না হয়, সে রাস্তায় যেতে হবে। তাহলেই রফতানি বাজারটি খুলে যাবে এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।’
২০২২ সালে অন্যান্য মোটরযানের মধ্যে ৭ হাজার ৬০৬টি অটোরিকশা, ২ হাজার ৬৮৮টি বাস, ৪ হাজার ৪২৪টি কাভার্ড ভ্যান, ৯ হাজার ৮০৪টি পিকআপ, ১ হাজার ৬০২টি ট্রাক্টর, ৪ হাজার ৫২৮টি ট্রাক বিআরটিএ থেকে নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাক নিবন্ধনের পরিমাণ ২০২১ সালের তুলনায় ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ কমেছে। ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ নিবন্ধন কমেছে পিকআপেরও। বিপরীতে বাসের নিবন্ধন বেড়েছে ৭৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ৩৭৭টি ট্রাক, ২২৪টি বাস, ৮১৭টি পিকআপ ও ৪২ হাজার ২৪৩টি মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে।