'"পেমেন্ট গেটওয়ে কী?" এ বিষয়ে একটি আর্টিকেল লেখো,'—সম্প্রতি চ্যাটজিপিটির কাছে এমন প্রশ্ন রেখেছিলাম আমি। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) শক্তিতে চালিত লেখা তৈরিকারী এ টুলটি সঙ্গে সঙ্গে আমার হুকুম তামিল করল।
চ্যাটজিপিটি যা লিখে দিল, তা এককথায় অনবদ্য। হ্যাঁ, হয়তো লেখার সুরটা মানবীয় হয়নি—কিন্তু লেখার মূল বক্তব্য, ব্যাকরণ ও পদবিন্যাস সবই ছিল যথার্থ।
ওই লেখাটার ওপর একটু হাত চালানোর পরই ওটা কোনো ওয়েবসাইটে প্রকাশযোগ্য কপিরাইটিং আর্টিকেল হিসেবে দিব্যি চালিয়ে নেওয়ার মতো হয়ে গেল। আর এ ধরনের আর্টিকেল আমার মতো পেশাদার কপিরাইটারেরা লিখেন। যেগুলো লেখার পেছনে আমাদের কয়েক ঘণ্টা ব্যয় হয়।
অবাক হওয়ার পালা ততক্ষণে শেষ। চ্যাটজিপিটির এ খেল দেখে আমি এবার একটু ভয় পেতে শুরু করলাম। লেখাটা লিখতে এটির মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মতো সময় লেগেছে। তা-ও লিখে দিয়েছে বিনামূল্যে। এ ধরনের একটি আর্টিকেল লিখতে আমি ৫০০ পাউন্ড নিই।
চ্যাটজিপিটি তৈরি করেছে ওপেনএআই। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এমন এক চ্যাটবট যাকে ব্যবহারকারীর সঙ্গে স্বাভাবিক ও কথোপকথনের ধাঁচে আলাপ করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর তৈরি করতে সক্ষম এ চ্যাটবটের লেখাগুলো প্লেজিয়ারিজম চেকার দিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, লেখাগুলো শতভাগ স্বতন্ত্র।
এ লেখাটি লেখার জন্যও আমি চ্যাটজিপিটিকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। আর এভাবেই লেখাটি শুরু করেছে চ্যাটজিপিটি:
একজন কপিরাইটার হিসেবে, আমি বছরের পর বছর আমার কাজে শান দিয়েছি। আগ্রহোদ্দীপক ও বিশ্বাসযোগ্য আর্টিকেল লেখার জন্য আমার সক্ষমতাকে তৈরি করেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওপেনএআইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া বৃহৎ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল চ্যাটজিপিটি আমার এ পেশাটাকে দখল করার ঝুঁকিতে ফেলেছে।
চ্যাটজিপিটির নির্মাতা স্বীকার করেছেন, এর এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা যত বেশি এটা ব্যবহার করব, এটি ততই উন্নত হবে। এটি এখনই 'বিভিন্ন লেখকের লেখার ধরন অনুকরণ করতে পারে'। পাশাপাশি একে 'কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠানের চরিত্র ও সুরকে নকল করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে'।
আমার মনে হচ্ছে, কোনো কোম্পানি যদি তাদের সরবরাহ চেইনের খরচ কমিয়ে হিসাবের খাতায় উন্নতি আনতে পারে, তাহলে তারা তা করবেই। অর্থনৈতিক সুবিধার কথা চিন্তা করে মানুষের তৈরি করা কনটেন্টকে বাতিল করে দিতে অনেকেই দুবার ভাববে না। হাজার হোক, এআই হচ্ছে অতি-দ্রুততাসম্পন্ন শ্রমশক্তি যা কিনা খায় না, ঘুমায় না, অভিযোগ করে না বা ছুটি নেয় না।
ভবিষ্যতের দুনিয়ায় লেখক ও সম্পাদকদের অবশ্যই প্রয়োজন হবে, কিন্তু তাদের সংখ্যা হবে অনেক কম। একজন মানুষ বসে বসে এআইকে বলবে আর্টিকেল লিখতে। সেই মানুষের কাজ হবে কেবল তথ্যের সত্যতা যাচাই, ভুল শুদ্ধিকরণ ও লেখা অনুমোদন করা।
কিন্তু মানুষের কোনো সাহায্য ছাড়া একেবারে নিজে থেকেই নিখুঁতভাবে প্রয়োজনমাফিক বাণিজ্যিক কনটেন্ট তৈরি করতে কতদিন-ই-বা সময় নেবে এআই?
এআইয়ের কারণে ইতিমধ্যে তিন শতাংশ চাকরি ঝুঁকির মুখে বলে জানিয়েছে প্রাইসওয়াটারহাউসকপার নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এআইয়ের কারণে ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য অনেক মানুষকে তাদের কর্মদক্ষতায় আরও শান দিতে হবে অথবা কাজ হারাতে হবে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রযুক্তি যখন মানুষকে প্রতিস্থাপিত করেছে, তখন মানুষ নিজের জন্য নতুন আরেকটি উদ্দেশ্য খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু এআইয়ের ক্ষেত্রে যদি তা না হয়? মানুষ তাদের ভূমিকাকে নতুন করে সাজানোর আগেই এআই যদি মানুষকে আরও সেকেলে করে দেয়?
কিছু পর্যবেক্ষকের পরামর্শ, এআই থেকে পাওয়া সম্পদের মাধ্যমে একটি বৈশ্বিক মৌলিক আয় (ইউবিআই) পরিশোধ পদ্ধতিই ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে সেরা উপায় হতে পারে। ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যানের দাবি, আমেরিকার প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে বছরে ১৩ হাজার ৫০০ ডলার পরিশোধ করতে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থনৈতিক উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে পারবে এআই। একইসঙ্গে এটি পণ্য ও সেবার খরচও নাটকীয়ভাবে কমাতে পারবে।
কিন্তু কাজ কেবল আয় নয়, অনেকের কাছে কাজের মর্মার্থ রয়েছে। এআইয়ের জয়জয়কারের প্রকৃত সমস্যাটি সৃষ্টি হতে পারে মানুষের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনতা জন্মানোর কারণে। উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, নেশা ইত্যাদি তৈরিতে ভূমিকার রাখতে পারে।
শ্রমবাজারে এ প্রবল পরিবর্তন মোকাবিলা করতে সরকারগুলো ইতোমধ্যে বিভিন্ন কৌশল তৈরিতে কাজ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আমি প্রতিটি মানুষকে এমনটা করতে বলব। আমি নিজে অবশ্যই তা করব।
আর যেকোনো বৈপ্লবিক প্রযুক্তির মতো, এআই আগামী দশকগুলোতে আমাদের জীবনকে কীভাবে পরিবর্তন করবে তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত: পরিবর্তনটা আসছে। আর যারা এ পরিবর্তনকে মেনে নেবে এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাপ খাইয়ে নেবে, তারাই টিকে থাকার জন্য মজবুত অবস্থানে থাকবে।
চ্যাটজিপিটির ভাষায়-
প্রযুক্তির ব্যবহার ও মানুষের মানবস্পর্শ—এ দুইয়ের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে পাওয়াটাই মূল চাবিকাঠি। কপিরাইটিং একটি শিল্প এবং এর জন্য দরকার সৃজনশীলতা, সমানুভূতি ও টার্গেট অডিয়েন্স বোঝার ক্ষমতা। তাই, চ্যাটজিপিটি আমার চাকরি নিয়ে নেবে না, বরং আরও প্রভাবপূর্ণ ও শক্তিশালী আর্টিকেল লিখতে এটি আমার সহযোগী হবে।
কিন্তু এআই তো এমনটাই বলবে, তাই না?