দেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয় করা হবে। যদিও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এখন বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম কমলেও তা স্থিতিশীল নয়। তাই দেশের বাজারে এখনই পণ্যের দাম কমানো বা সমন্বয় করা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বাজারে এখনই জ্বালানি তেল কিংবা গ্যাসের দাম কমানোর পরিকল্পনা নেই সরকারের। সরকার মূলত ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেশকিছু শর্তও রয়েছে। তাই কমানোর পরিবর্তে বরং আরো কয়েক দফা গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) ব্যারেলপ্রতি দাম গত বছরের ৯ জুন ছিল ১২১ ডলার ৫১ সেন্ট। গতকাল তা ছিল ৬৮ ডলার ২০ সেন্ট। সে হিসেবে গত নয় মাসে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে ৪৪ শতাংশ। আর আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম গত বছরের জুনে ছিল ১২২ ডলার ১ সেন্ট। বর্তমানে তা মূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ৭৬ ডলার ২৬ সেন্টে। এ সময়ের মধ্যে ব্রেন্টের দাম কমেছে ৩৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এছাড়া স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ (মিলিয়ন মেট্রিক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) রেকর্ড সর্বোচ্চ ৬৯ ডলার ৬১ সেন্টে গিয়ে উঠেছিল। বতর্মানে তা কমে নেমেছে ১৩ ডলার ১৫ সেন্টে। অর্থাৎ গত সাড়ে ছয় মাসেরও বেশি সময়ে এলএনজির দাম কমেছে ৮১ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপক হারে কমলেও সরকার চাইছে দেশের বাজারে তা না কমিয়ে লোকসান ও ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে। এছাড়া এ মুহূর্তে সেই সুযোগ সরকারের হাতেও কম বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, আইএমএমের ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নানা ধরনের নির্দেশনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনার মাধ্যমে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানো। সে নির্দেশনা বাস্তবায়নের দিনকাল খুব দ্রুতই শুরু হতে যাচ্ছে। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ে একটি সময়ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করতে হবে। ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত মাসে বুঝে পেয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের সময় শর্ত পরিপালন ও সংস্কার পর্যালোচনা করে দেখবে আইএমএফ। এটিকে অতিজরুরি হিসেবে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম কমলেও দেশের ভোক্তারা এর সুফল যে পাচ্ছে না তা অনেকটাই নিশ্চিত। এক্ষেত্রে আইএমএফের শর্তই প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে। তার পরও জ্বালানি তেল বা গ্যাসের দাম কমাতে চাইলে সরকার তা কীভাবে কমাবে সে বিষয়ে নতুন করে রূপরেখা খুঁজতে হবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
দেশে জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহ কার্যক্রমের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সংস্থাটি জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে জ্বালানি বিভাগ বিপিসির লাভ-লোকসানের হিসাব আমলে নিয়ে মূল্য সমন্বয়ের ঘোষণা দেয়। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেন, ‘আমরা বাজার পর্যালোচনা করছি। তবে এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর মতো পরিস্থিতি আসেনি। এ বিষয়ে পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করব।’
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট তৈরি হয়। এর ছয় মাসের মাথায় পণ্যটির দাম এক লাফে বেড়ে যায় ৫০ শতাংশ। এলএনজির দামও বাড়তে থাকে হু হু করে। দেশের বাজারেও তাই জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ানো হয় কয়েক দফায়। এর মধ্যে তিন দফা দাম সমন্বয় করে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি বেড়েছে ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অকটেনে লিটারপ্রতি ৫১ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং পেট্রলে লিটারপ্রতি ৩১ দশমিক ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। মূল্য সমন্বয়ের পর বর্তমানে ডিজেল ও কেরোসিন লিটারপ্রতি দাম ৬৫ থেকে বেড়ে ১০৯ টাকা হয়েছে। এর মধ্যে দুই দফা দাম বেড়েছে, আর এক দফা কমেছে। এছাড়া অকটেন লিটারপ্রতি ৮৯ থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা এবং পেট্রল লিটারপ্রতি ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ টাকা করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ, বৃহৎ শিল্পে ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং মাঝারি শিল্পের গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তিন দফায় ১৫ শতাংশ (প্রতিবার ৫ শতাংশ করে) বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে এক দফায় বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়।
এদিকে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে লাফিয়ে বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্য। বেড়েছে উত্পাদন ও পরিবহন খরচ। জনদুর্ভোগ বেড়েছে চরম পর্যায়ে। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশেও সমন্বয় করা হয়েছে। দাম কমলে তা আবারো সমন্বয় করা হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম কমলেও সরকার আর সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি।
জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার যদি জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমানোর পরিকল্পনাও করে তাতে সুফল পাবে না ভোক্তা। কেননা জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে অন্য জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এছাড়া ভর্তুকি ও লোকসান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা কমাতে আইএমএফের শর্তের প্রতিও দায়বদ্ধ সরকার।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘জ্বালানি পণ্যের দাম যখন বাড়ানো হয়েছিল, তখন বলেছিলাম—এটি পরবর্তী সময়ে কমালেও তার সুবিধা ভোক্তা পাবে না। ফলে এখন মূল্য কমানোর কোনো সিদ্ধান্ত হলেও সেখানে ভোক্তার সুফল পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে সরকার বিশ্ববাজারে দাম কমার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য টাকাটা গচ্ছিত রাখতে পারে। যাতে পরে আর দাম বাড়ানোর প্রয়োজন না পড়ে।’ তবে দেশের বাজারে পেট্রল ও অকটেনের দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পেট্রল ও অকটেনের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তা সরাসরি সুবিধাভোগী। এখানে মধ্যস্বত্বভোগী খুবই সীমিত।’
জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে জ্বালানি বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।