আরেক প্রতিবেশী দেশে পাকিস্তান সর্বশেষ ২০১৯ সালে ট্রেনের ভাড়া বাড়ায়। দেশটি নন-এসিতে কিলোমিটারপ্রতি ৫৬ পয়সা ও এসি আসনে কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ৪ পয়সা হারে ভাড়া আদায় করছে। অন্যদিকে শ্রীলংকায় নন-এসি আসনে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া আদায় হচ্ছে ৭৯ পয়সা।
দেশে ২০১৬ সালে নির্ধারণ করা হার অনুযায়ী, বাংলাদেশ রেলওয়ের কিলোমিটারপ্রতি ভিত্তি ভাড়া ৩৯ পয়সা। সংস্থাটির বিভিন্ন গন্তব্যের ভাড়ার হার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নন-এসি (প্রথম শ্রেণী/সিট) আসনে কিলোমিটার ১ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গন্তব্যভেদে এসি (সিট) আসনে আদায় হচ্ছে ২ টাকা ২৫ পয়সা থেকে আড়াই টাকা।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে রেলপথের দূরত্ব ৩৪৬ কিলোমিটার। এ দূরত্বে প্রথম শ্রেণীর (সিট) বর্তমান ভাড়া ৪৬০ টাকা। এ হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া আসে ১ টাকা ৩৩ পয়সা। একই মানের আসনে প্রতিবেশী ভারতে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া আদায় করা হয় ৪৬ পয়সা (বাংলাদেশী টাকা)। পাকিস্তানে আদায় হয় কিলোমিটারপ্রতি ৫৬ পয়সা। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলংকায় একই মানের আসনে কিলোমিটারপ্রতি ৭৭ পয়সা। ঢাকা-চট্টগ্রামে এসি (সিট) আসনের কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ২ টাকা ২৮ পয়সা। একই মানের আসনে ভারত ও পাকিস্তানে এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে যাত্রীদের খরচ করতে হয় যথাক্রমে ২ টাকা ৩ পয়সা ও ২ টাকা ৪ পয়সা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের বিদ্যমান ভাড়ার হার অনুযায়ী প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার চেয়ে বেশি। এমন অবস্থায় আরেক দফা ভাড়া বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সম্প্রতি ২৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত যাত্রী ভাড়া বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্যারিফ কমিটি। সুপারিশ কার্যকর হলে ট্রেনের এসি বার্থ আসনের ভাড়া সমদূরত্বের গন্তব্যে বিমান ভাড়ার কাছাকাছি চলে আসবে। নন-এসি আসনের ভাড়া চলে আসবে নন-এসি বাস ভাড়ার কাছাকাছি। যদিও রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, এখনই ভাড়া বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সর্বশেষ ২০১৬ সালে ভাড়া বাড়িয়েছিল। ওই সময় ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। রাজস্ব আয় বাড়ানোর তাগিদ ও প্রতিযোগী যানবাহনের ভাড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা—অতীতে ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মোটাদাগে এসব যুক্তিই দেখিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তবে বিশেষজ্ঞরা এসব যুক্তিকে ঠুনকো হিসেবে অভিহিত করছেন। যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করে নয়, রেলওয়ের পরিচালন ব্যয়ের সিংহভাগ পণ্য পরিবহন ও বিভিন্ন অবকাঠামোর মাধ্যমে সংগ্রহ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ট্রেন এমন একটি অবকাঠামো, সব ধরনের পরিবেশে যার পরিচালন ব্যয় প্রায় একই রকম থাকে। অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান কিংবা শ্রীলংকায় একটি ট্রেনের পরিচালন ব্যয় যত হবে, বাংলাদেশেও একই রকম হওয়ার কথা। এমন অবস্থায় ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের ভাড়ার এত তারতম্য হওয়ার কোনো কারণ দেখেন না তিনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিকল্পনায় বড় ধরনের ভুল আছে উল্লেখ করে ড. সামছুল হক আরো বলেন, পৃথিবীজুড়ে রেলের রাজস্ব আয়ের প্রধান মাধ্যম পণ্য পরিবহন। সেখানে বাংলাদেশ রেলওয়ে হাঁটছে উল্টোপথে। সংস্থাটির নিজস্ব কনটেইনার কোম্পানি থাকলেও সেটির কোনো কার্যক্রম নেই। হাজার হাজার একর জমি অলস ফেলে রাখা হয়েছে। এসব জমি কাজে লাগিয়েই তো রেলের পরিচালন ব্যয়ের সিংহভাগ উঠিয়ে আনা সম্ভব। ভাড়া বাড়ানোয় কোনো দোষ দেখেন না তিনি। তবে ভাড়া বাড়ানোর আগে যাত্রীসেবার মান বাড়ানো উচিত, যে কাজটি বাংলাদেশ রেলওয়ে ঠিকমতো করতে পারছে না বলে মনে করেন তিনি।
রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন রেলওয়ে ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও সেটি এখনই বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন । তিনি বলেন, রেলওয়ের ভাড়া বাড়ানোর জন্য অনেক আগে একটা কমিটি হয়েছিল। এ কমিটি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে এখনই ভাড়া বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা রেলওয়ের নেই। ভাড়া বৃদ্ধি সম্পর্কিত যে খবরটি আলোচনা হচ্ছে, গণমাধ্যমে সেটির ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি বর্তমান সরকার রেলের যাত্রীসেবার মান বাড়াতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।