চট্টগ্রাম কাস্টমসের হিসাবে, চলতি অর্থবছর মোট ৭৪ হাজার ২০৬ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৬২ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৪৮ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের (জুলাই-এপ্রিল) ১০ মাসে মোট ৪৮ হাজার ৬০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করেছিল চট্টগ্রাম কাস্টমস। এ হিসাবে অর্থবছরের ১০ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
এদিকে রাজস্ব আহরণে মাসভিত্তিক হিসাব করলে আরো নেতিবাচক চিত্র উঠে আসে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের হিসাবে বিগত অর্থবছরের এপ্রিলের তুলনায় চলতি অর্থবছরের এপ্রিলে রাজস্ব আয় কমেছে ১৫ শতাংশ। গত এপ্রিলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। যার বিপরীতে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। শুধু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, শুল্ক-কর আদায়েই নয়, পিছিয়ে প্রবৃদ্ধি বিবেচনায়ও। গত অর্থবছরে এপ্রিলে ৫ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল চট্টগ্রাম কাস্টমস।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, ধারাবাহিক বিবেচনায় প্রতি বছরই গড়ে ১২ শতাংশের বেশি রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়ে আসছে। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে গত অর্থবছরই শুধু প্রবৃদ্ধি এর অর্ধেক অর্থাৎ ৬ শতাংশের মতো হয়েছে। চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি আটকানোই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফাইজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজস্ব আয়ে এখন যে পরিস্থিতি তাতে গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশেরও কম দেখাচ্ছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসে রাজস্ব আয়ের বড় খাতগুলোতেই আমদানি অনেক কমেছে। তবে এটাও ঠিক যে আমদানি প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যদি আমরা প্রাপ্য রাজস্ব পেতাম, তবে প্রবৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় ১৯ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারত। এটা আমরা হিসাব করেই দেখেছি। যেমন এক পেট্রোবাংলার কাছেই চট্টগ্রাম কাস্টমস ৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পায়। যেটি আদায় করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিপিসির অধীনে পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ যেসব প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল আমদানি করছে, তাদের রাজস্ব আয় করা যাচ্ছে না। কারণ বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও এ সংস্থার পক্ষ থেকে ইনভয়েস দেয়া হচ্ছে না। অথচ সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থা যেটিই হোক, আমদানি প্রক্রিয়ায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে ইনভয়েস প্রদান করা বাধ্যতামূলক।’
বৈদেশিক বাণিজ্যের বর্তমান প্রবণতা কেমন, সে ব্যাপারে ধারণা মেলে চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম বিশ্লেষণে। দেশে সমুদ্রপথে পণ্যের ৯৩ শতাংশই আমদানি-রফতানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বছরভিত্তিক হিসাবে চলতি বছরের চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) ৩ কোটি ৯৮ লাখ টন খোলা পণ্য (কার্গো) ওঠানামা হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালের একই সময়ে যা ছিল ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার টন। এছাড়া চলতি বছর চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) এ বন্দর ২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ৯ লাখ ১০ হাজার একক। আগের বছর একই সময়ে যা ছিল ১০ লাখ ৭৭ হাজার একক। অর্থাৎ পণ্য আমদানি-রফতানিতে বাল্ক ও কনটেইনার দুই ক্ষেত্রেই হ্যান্ডলিং কার্যক্রম কমেছে। চলতি বছর গত চার মাসে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে ১ হাজার ৩৭২টি। আগের বছর একই সময়ে যা ছিল ১ হাজার ৪৭৫টি।
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ধাক্কা সব খাতেই পড়েছে। ডলারের সংকট চলায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা বিধিনিষেধের কারণে আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে। ফলে রাজস্ব আয়ে এটা সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। ব্যবসা অব্যাহত থাকলে পণ্য আমদানি হবে এতে করে কারখানার চাকা ঘুরবে, বন্দরও সচল থাকবে। রাজস্বও বাড়বে। কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত আমদানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
ভোগ্যপণ্য ও শিল্পপণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার সিমেন্ট ও সি কম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ একটি ভালো পদক্ষেপ। তবে আমদানি কমিয়ে রাখা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমার অর্থ হলো শিল্পের উৎপাদন কমে যাওয়াসহ রফতানি কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটা। এতে উৎপাদনে যুক্ত কর্মসংস্থান হোঁচট খায়। সংকটের শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি বিলাসপণ্য ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করলেও কাঁচামালের আমদানিতে সবসময় অগ্রাধিকার দিয়ে রাখতে হবে। নতুবা দীর্ঘ সময় আমদানি কম হলে বড় ঝুঁকি তৈরি হবে।’