বাংলা লেখার ভুল সংশোধন করবে 'সঠিক' অ্যাপ

বাংলা লেখার ভুল সংশোধন করবে 'সঠিক' অ্যাপ
বানান, ব্যাকরণ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকার পরেও প্রায়ই ভুল লিখে বসি আমরা। ফেসবুক বা দাপ্তরিক কাজ- যেকোনো জায়গাতেই এ নিয়ে অনেক সময়ই বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তে হয়।

কিন্তু যখন ইংরেজিতে কিছু লেখা হয়, তখন এই ভুলগুলো কিন্তু এত হয় না। বিশেষ করে, বানানের ভুলটা একদমই কম হয়। অথচ, স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজির চেয়ে বাংলায় আমাদের দক্ষতা বেশি থাকার কথা।

এর কারণ, অনলাইনে বাংলায় লেখার সময় আমরা সাধারণত অভ্র বা বিজয় কিবোর্ডে লিখি। এসব কিবোর্ডের নিজস্ব স্পেল চেকার (বানান পরীক্ষার প্রযুক্তি) থাকলেও সেগুলো প্রায়শই ভুলগুলো ধরতে পারে না। দেশীয় কিছু ওয়েবসাইট এবং মোবাইল অ্যাপও আছে বাংলা বানান ভুল ধরার জন্য। কিন্তু এগুলোর ব্যবহার পদ্ধতি বেশ জটিল এবং অনেকগুলো এখন আর কাজ করে না। ফলে, বাংলা বানানের অনেক ভুল আমাদের লেখায় রয়েই যায়। এসব ভুল থেকে মুক্তি দিতে এসেছে নতুন স্পেল চেকার 'সঠিক'।

ব্যক্তিপর্যায়ে না, বরং সরকারি উদ্যোগ
মূলত বাংলা ভাষার শব্দ, বাক্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে সম্পাদনা করার সফটওয়্যার সঠিক। এটিতে বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানবিধি ও প্রমিত বানান অভিধানকে অনুসরণ করা হয়েছে। সরকারের উদ্যোগেই তৈরি করা এই সফটওয়্যারকে বর্তমানে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ স্পেল চেকার সফটওয়্যার হিসেবে দাবি করা হচ্ছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ২০১৭ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণের প্রকল্প হাতে নেয়। বাংলা ভাষায় ১৬টি টুলস তৈরি করার জন্য এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়। এই ১৬টি টুলসের একটি হলো বানান শুদ্ধ করার সফটওয়্যার সঠিক।

কী কী সেবা দেবে
বাংলা বানান এবং ব্যাকরণ সংশোধক হিসেবে কাজ করবে সঠিক। অনেকটা ইংরেজি গ্রামারলি-এর মতো ব্যবহার করা যাবে এটিকে। সফটওয়্যারটি যেসব ভুল শনাক্ত করতে পারবে সেগুলো হচ্ছে টাইপো (টাইপের ভুলের কারণে যে ভুলগুলো হয়); প্রচলিত বানান ভুল, যাকে বলে মিস্পেল ওয়ার্ড (যেমন 'চুরি' বানানকে 'চুড়ি' লেখা, 'পড়ালেখা'কে 'পরালেখা' লেখা); রিয়েল ওয়ার্ড এরর বা কন্টেক্সচুয়াল এরর (যে শব্দগুলো আসলে সঠিক, কিন্তু বাক্যের অর্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন 'আমি নতুন জামা পরবো' কে নতুন 'মামা' পরবো লেখা) ইত্যাদি। এছাড়া কোথায় কোন যতিচিহ্ন বসবে, কোথায় স্পেস (ফাঁক) বসবে বা বসবে না, কোথায় সাধু-চলিতের মিশ্রণ, লেখায় বাহুল্য দোষ, প্রত্যয়-বিভক্তির ব্যবহারে ভুল, কর্তা-ক্রিয়ার সম্পর্কে ভুলগুলোর মতো শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ ভুলই ধরিয়ে দিতে পারবে এ সফটওয়্যার।

কেবল ভুল শনাক্ত করাই নয়, পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধনের পরামর্শ দেবে সঠিক। তবে নতুন কোনো নাম (যাকে আমরা নামবাচক বিশেষ্য বলে থাকি) ভাষায় যুক্ত হলে সেটা ধরতে পারবে না। ব্যবহারকারীদের ডেটা বিশ্লেষণ করে সফটওয়্যারটি সমৃদ্ধ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

নেপথ্যের কাজ
আইসিটি বিভাগের এই প্রকল্পের পরিচালনায় সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে মূলত রিভ সিস্টেমস লিমিটেড। তবে এই উদ্যোগের সঙ্গে ২০১৭ সাল থেকে যুক্ত রয়েছেন মামুন অর রশীদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেন, সেই সঙ্গে বাংলা কম্পিউটিং নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন মামুন। তাই প্রকল্পের জন্য যখন আহ্বান করা হলো, তিনি সাগ্রহে রাজি হন — বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে প্রকল্পের কাজে যোগ দিন। সঠিক সফটওয়্যারটির কার্যপরিধি তৈরির সময় থেকে তিনি এর সাথে যুক্ত। এটিতে কী কী ফিচার থাকবে, সেসব ফিচারের ব্যাকগ্রাউন্ড, ফিচার মেথড কী হবে — এসব বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রিভ সিস্টেমসের ডেভেলপার হিসেবে মেসবাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে আছে একটি দল। মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন রাকিব আনসারী। এছাড়াও বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ (সিএসই) থেকেও একটি দল যুক্ত হয়েছে যারা মূলত সফটওয়্যারটির টেস্টিং করেছে। ডেটাসেট এবং কোডিংয়ের জন্য মোট দুই ডজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ও ভাষা বিশেষজ্ঞ কাজ করেছেন। মামুন জানান, সব কাজের মধ্যে সবচেয়ে শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ কাজ ছিল ডেটাসেট তৈরি করা। এসব ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে নিয়মিত মিটিং করতে হয়েছে ডেভেলপমেন্ট মেথডোলজি নিয়ে। কখনো কখনো প্রতিদিন টানা ৫-৬ ঘণ্টা মিটিংও করতে হয়েছে বলে তিনি জানান।

সফটওয়্যারটিতে বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। বাংলা একাডেমির অভিধানে মোট শব্দ আছে ৭৫–৮০ হাজার। তবে সঠিক-এর নির্মাতারা কাজ করেছেন প্রায় আট লাখ শব্দ নিয়ে। এই শব্দগুলোর সাথে বিভিন্ন মার্কার যুক্ত হওয়ায় এই শব্দের তালিকা শতগুণ বেড়েছে। ফলে শক্তিশালী হয়েছে সফটওয়্যার।

চলছে পরীক্ষামূলক ব্যবহার
করোনার সময়ে রাত-দিন এক করে কাজ করেছেন তারা। সে সময়েই কাজের সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান মামুন। কাজ অবশ্য এখনো চলমান। গত ২১ ফেব্রুয়ারি সঠিক টুলের পরীক্ষামূলক সংস্করণ সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে সফটওয়্যারটি এখন সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে তাদের প্রতিক্রিয়াও জানাচ্ছেন।

তেমনই একজন ব্যবহারকারী কামিল মুত্তাকী। তিনি ওয়েবসাইটে নিজের মতামত জানিয়ে লেখেন, 'বাংলা বানানের ভুল সংশোধনের এটি একটি দারুণ অ্যাপ্লিকেশন। যদিও বহুল ব্যবহৃত অভ্র কি-বোর্ডের উইন্ডোজ ভার্সনে এক ধরনের স্পেল চেকার আছে। তবে আমার ব্যবহারে সেখান থেকে শতভাগ সঠিক ফলাফল পাইনি। তবে ৮০-৯০ ভাগ ক্ষেত্রে কার্যকরই বলা যায়। বড় লেখা সম্পাদনের ক্ষেত্রে অনেকটাই কাজে দিত। এখন এই অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে বানানের ভুল নির্ণয় এবং সঠিক বানানের পরামর্শও পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এটিকে শক্তিশালী করেছে এবং দিনে দিনে এটি আরও সমৃদ্ধ হবে।'

আরেকজন ব্যবহারকারী সাদিয়া হাসান জানান, 'আমি সবসময় এমন অ্যাপই চাইতাম যা দিয়ে আমার কাজ সহজ হয়ে উঠবে। আমি এর কাজে খুবই মুগ্ধ। তবে একটা অনুরোধ, যদি কোনো অপশন থাকত এক ক্লিকেই সব একবারে মুছে ফেলার, তবে খুব ভালো হতো। সিলেক্ট করে করে ডিলিট করতে অনেক সময় লেগে যায়।'

মামুন জানান, 'বিভিন্ন পত্রিকা, প্রকাশনা, ইন্ডাস্ট্রি, সরকারি লোকজনসহ বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১১ হাজার জন সঠিক টুলটি ব্যবহার করছেন। তবে গ্রামার চেকার সুবিধা এখনো যুক্ত করা হয়নি। আর মোবাইলে ব্যবহারের জন্য সফটওয়্যারটির জন্য একটি কিবোর্ড এবং ব্রাউজারে ব্যবহার করার জন্যও প্লাগ-ইন তৈরির কাজ চলছে।

মিলবে কিছু বাড়তি ফিচারও
সঠিক সফটওয়্যারটি লেখালেখির সঙ্গে সম্পর্কিত কম্পিউটার জগতের গুরুত্বপূর্ণ সব মাধ্যমে ব্যবহার করা যাবে। মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে সাধারণ কম্পোজের (লেখালেখির) সময় বানান পরীক্ষা ও সংশোধন করা যাবে একটি 'অ্যাড-ইন' যুক্ত করে। অর্থাৎ অভ্র বা বিজয়ে লিখলেও সঠিক অ্যাপের স্পেল চেকার ব্যবহার করা যাবে। এ জন্য অন্য কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে না। ইন্টারনেটে কিছু টাইপ করার সময় — বিশেষ করে বহুল ব্যবহৃত ক্রোম, ফায়ারফক্স, সাফারি ও এইজ ব্রাউজারের জন্য রয়েছে অ্যাড-অনস। এতে সার্চবার বাদে বাকি সব কাজেই চাইলে স্পেল চেকারটির সাহায্য নেওয়া যাবে। সেই সাথে ফেসবুক, জিমেইল, গুগল ট্রান্সলেশনে বাংলা বানানের শুদ্ধতা যাচাই করার সুবিধাও দিচ্ছে এটি।

এ তো গেল কম্পিউটারের ব্যবহার। মোবাইলের জন্য তৈরি করা একটি অ্যাপ প্লে স্টোর থেকে ইন্সটল করে ব্যবহার করা যাবে। মোবাইলে আমরা যে-সব প্রচলিত কিবোর্ড অ্যাপ ব্যবহার করি, সে সব অ্যাপেও এটি অনায়াসে বানান সংশোধন করে দেবে।

এছাড়া সঠিক অ্যাপের রয়েছে একটি স্বতন্ত্র কিবোর্ড, যার মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে শুদ্ধ বাংলায় লেখা যাবে। কেউ চাইলে তাই সঠিক অ্যাপের কিবোর্ডও ব্যবহার করতে পারেন নিজের মোবাইলে। বাড়তি সুবিধা হিসেবে রয়েছে ইলাস্ট্রেটর অ্যাড-ইনস।

সঠিক সফটওয়্যারটি অন্য ডেভেলপাররা যাতে ব্যবহার করতে পারেন, সে জন্য রয়েছে এপিআই। এ ছাড়া সব ফিচারসহ অ্যাপের একটি স্ট্যান্ড-অ্যালোন ভার্সন রয়েছে; যা একই সঙ্গে উইন্ডোজ, লিনাক্স, ম্যাক এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন হিসেবেও কাজ করবে।

এডিটিংয়ের ক্ষেত্রেও দু ধরনের ফিচার রয়েছে সফটওয়্যারটির। ইনলাইন এডিটিং ও সাইডবার এডিটিং দুটোই থাকায় যেকোনো আর্টিকেল সম্পাদনার কাজ সহজ করবে সফটওয়্যারটি। ইতোমধ্যে এসব ফিচার তৈরির কাজ শেষ। তবে টেস্টিং চলছে বলে এখনো উন্মুক্ত করা হয়নি সবার জন্য।

সবার জন্যে বিনামূল্যে
অজ্ঞতার কারণে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার অনেক সীমিত। ইংরেজিকেই যেন আমরা তথ্যপ্রযুক্তি বা অনলাইনের একমাত্র ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছি। তবে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার ব্যবহার আমাদের দেশে এখন ধীরে ধীরে বাড়ছে। এ বিষয়ক বিভিন্ন টুল তৈরি হচ্ছে। সরকারও এ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠছে।

পরীক্ষামূলকভাবে সঠিক এখন সকলেই ব্যবহার করতে পারবেন এবং ফিডব্যাক জানাতে পারবেন। ২০২৪ সালের মধ্যে এর কাজ পুরোপুরি শেষ হবে বলে নির্মাতাদের প্রত্যাশা। যে কেউ বিনামূল্যেই এ সফটওয়্যারের সেবা পাবেন। তবে সবার জন্য উন্মুক্ত করার পরও এর উন্নয়ন কাজ চলতে থাকবে নিয়মিত। এভাবেই প্রযুক্তির দুনিয়ায় ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাও একদিন হয়ে উঠবে শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ এক ভাষা।

অর্থসংবাদ/এসএম

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

স্মার্টফোনে ম্যালওয়্যার ছড়াচ্ছে ১৪ অ্যাপ
ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হলে যা করবেন
গোপন নয় ‘ইনকগনিটো’ মুড, গুগলকে ৫৪ হাজার কোটির জরিমানা
বৈদ্যুতিক গাড়ি আনছে শাওমি
গুগল ক্রোম বাংলায় ব্যবহার করবেন যেভাবে
ডিলিট হওয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ফিরে পাবেন যেভাবে
ওয়েবসাইটে জি-মেইল অ্যাড্রেস আনসাবস্ক্রাইব করবেন যেভাবে
আইফোন চুরি হলেও আইডির সুরক্ষা দেবে নতুন ফিচার
দেশে সক্রিয় মোবাইল সিমের সংখ্যা জানালেন প্রধানমন্ত্রী
আইফোনের ব্যাটারির আয়ু বাড়ানোর উপায়