প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে প্রায় তিন মাস সাধারণ ছুটি থাকায় অফিস-আদালত, বিপণিবিতান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পর্যটন ও পরিবহন বন্ধ ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ রয়েছে। এতে রিকশা ও অটোরিকশা চালক, গণপরিবহন শ্রমিক, ফুটপাতের ব্যবসায়ী, হকার, চায়ের দোকানদারসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান। হোটেল-রেস্তোরাঁ, বেকারি, পর্যটন, এমনকি বিভিন্ন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানও কার্যক্রম বন্ধ করে কর্মীদের ছুটিতে পাঠায়। বৈশ্বিক যোগাযোগ ভেঙে পড়ায় আমদানি-রপ্তানিও আশঙ্কাজনকভাবে সীমিত হয়ে পড়ে। শিল্পোৎপাদন কমে যায়। এতে কৃষি, শিল্প ও সেবা তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দেয়। মানুষের আয় কমে যায়। বাড়তে থাকে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য।
করোনা বিস্তার রোধে শিল্প, সেবা খাতে স্থবিরতা দেখা দিলেও দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি কৃষি খাতে তার বিশেষ প্রভাব পড়েনি। করোনাকালেও স্বাভাবিকভাবে চলেছে কৃষি খাতের কর্মকাণ্ড। প্রধান প্রধান ফসল, গবাদি পশু, মাছের উৎপাদন ও বিপণনে সমস্যা হয়নি। ফলে দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে যেমন কোনো চাপ সৃষ্টি হয়নি, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিও ভেঙে পড়েনি। তবে ঘূর্ণিঝড় আম্পান, জুলাই-আগস্ট সময়ের অতিবৃষ্টি, পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা এবং নদীভাঙনের কারণে আউশ, আমন ধান, পাট, শাকসবজি, মসলা এবং গাছপালা ও পশুপাখির ক্ষতি হয়েছে। এরপরও কৃষি মন্ত্রণালয় আশা করছে, কৃষিপণ্যের উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে।
গত ৩ আগস্ট সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়ার পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। মানুষ স্বাভাবিক সময়ের মতো ঘর থেকে বের হচ্ছে। কাজ করছে। রাজধানী ঢাকাসহ অন্য শহরগুলো আগের চেহারায় ফিরেছে। সড়কে যানজট দেখা যাচ্ছে। সেই আগের মতো দোকান বসছে ফুটপাতে। চায়ের স্টল, কফি শপ, হোটেল-রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে। ভিড় বাড়ছে পর্যটন কেন্দ্রে। আমদানি করা নতুন পণ্য নিয়ে জাহাজ ভিড়ছে বন্দরে। আবার অনেক জাহাজ রপ্তানি পণ্য নিয়ে বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে বিদেশে। ফলে অর্থনীতিও জেগে উঠছে।
করোনার আঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটনও জেগে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে মানুষ বেড়াতে যাচ্ছেন। সমুদ্রসৈকতে ভিড় জমছে। আবার জমজমাট হচ্ছে বিনোদনকেন্দ্রগুলো। হোটেল-মোটেলগুলোতে ফিরছেন অতিথিরা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হচ্ছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন লকডাউনে থেকে মানুষের মনে এক ধরনের অবসাদ দেখা দিয়েছিল। সবকিছু চালু হওয়ার পর মানুষ বেড়াতে বের হচ্ছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। এপ্রিল-মে মাসে যেমন একেবারেই পর্যটক ছিল না, সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এখন কক্সবাজারের হোটেলগুলোতে কমবেশি অতিথি আছেন। এদিকে, পর্যটনের অন্যতম অনুষঙ্গ বিমান চলাচলও শুরু হয়েছে।
দেশের সকল রাস্তায় পরিবহন চালু হয়েছে পুরোদমে। রাজধানীতে আবার সেই ব্যস্ততা বা যানজট ফিরে এসেছে। এতে জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে ১১ হাজার টন জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে দৈনিক। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। তবে আয় বাড়েনি বিশেষ।
এদিকে, বাজারে মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ডগ্লাভসের মতো স্বাস্থ্য সুরক্ষার সরঞ্জাম, ওষুধ, অক্সিজেন, অক্সিজেন মাপার যন্ত্র, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেলের বেচাকেনা বেড়েছে বেশ। আবার ইন্টারনেটের পেছনে মানুষের খরচ বেড়েছে, যা ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে সামান্য হলেও স্বস্তি দিয়েছে। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে গত ছয় মাস ধরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার পুরোপুরি বন্ধ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ খাতের পরিবহন, শিক্ষা উপকরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন চাহিদার অন্যান্য পণ্যের ব্যবসাও তেমন একটা হচ্ছে না।