আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের সক্রিয় হচ্ছে সাইবার অপরাধীরা। বিদেশ থেকে কথিত সাংবাদিকতার নামে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে গুজব ছড়াচ্ছে বেশকিছু ব্যক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। এ কাজে জড়িতরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে অর্থ দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। চাঁদা না পেলেই শুরু হয় তাদের অপপ্রচার। এই অপপ্রচার থেকে রেহাই পাননি দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যানও। অপপ্রচারকারী গুজব চক্র তাদের চাহিদা মতো অর্থ না পেলে শুরু করে মনগড়া ও কাল্পনিক গল্প প্রচার। এ চক্রটি এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান, সেনাপ্রধান, সাবেক আইজিপি, বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠীসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে মনগড়া গল্প সাজিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার অনলাইভিত্তিক নতুন নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে গুজব প্রচারে ফের সক্রিয় হচ্ছে। এসব অপকর্ম করা নাম সর্বস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নাগরিক টিভি, করাপশন ইন মিডিয়ার নাম জানা থাকলেও নতুন করে এবার সামনে আসছে আরও কয়েকটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান। গত কয়েকদিন ধরে অর্গানাইজ ক্রাইম অ্যান্ড রিপোর্টিং প্রজেক্ট নামে দেশের অতিগুরুত্বপূর্ণ কিছু দপ্তরে সংবেদনশীল তথ্য জানতে চেয়ে ই-মেইল করা হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি ১৫ জন সাইবার সন্ত্রাসীকে শনাক্তও করেছে। নতুন করে এ সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদও করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, নাগরিক টিভি, করাপশন ইন মিডিয়ার পর নতুন করে অর্গানাইজ ক্রাইম অ্যান্ড রিপোর্টিং প্রজেক্টসহ বিভিন্ন নামে সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক কিছু পেইজ ও চ্যানেল থেকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও দপ্তরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে টিটো রহমান, নাজমুস সাকিব, জাওয়াদ নির্ঝর এবং জুলকার নাইন সায়েরসহ বেশ কয়েকজন ব্যাক্তি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন গুজব ছড়াচ্ছে। তাদের অপপ্রচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না বড় ব্যবসায়ীগোষ্ঠী, সরকারি কর্মকর্তা, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর ও পেশাজীবি সাংবাদিকরাও। ইতোমধ্যে অপপ্রচারে যুক্ত এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেশকিছু মামলাও হয়েছে। তারপরও তাদের এসব অপকর্ম বন্ধ হচ্ছে না।
সম্প্রতি এসব চক্র ই-মেইল করেছে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা অর্থসংবাদকে বলেন, ই-মেইলের মাধ্যমে আমাদের দপ্তর থেকে অতি সংবেদনশীন কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আমার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন কাল্পনিক ও মনগড়া অভিযোগ তুলে মতামত জানতে চেয়েছে। যেহেতু আমি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি দপ্তরের দায়িত্ব পালন করছি, তাই তারা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তাদের হীন চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করছি। যেহেতু তারা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও মনগড়া কাল্পনিক গল্প প্রচার করে আসছে, তাই আমি মনে করি এটি তাদের সেই অপপ্রচারেরই অপচেষ্টা মাত্র। আমি জানতে পেরেছি নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে তারা মাঠে নেমেছে।
এ বিষয়ে জানতে অর্গানাইজ ক্রাইম অ্যান্ড রিপোর্টিং প্রজেক্টের সদস্য পরিচয় দেওয়া জুলকার নাইন সায়েরের সাথে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, সম্প্রতি ইউটিউবভিত্তিক নাগরিক টিভির মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে টিটো রহমান এবং নাজমুস সাকিবের বিরুদ্ধে রংপুরে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই মামলায় আরও অন্তত ১০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। মামলাটি আমলে নিয়ে রংপুরের সিআইডি পুলিশ সুপারকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক ড. আব্দুল মজিদ। এছাড়াও ফেসবুক পেইজে আক্রমণাত্মক, অসত্য, বানোয়াট ও মানহানিকর তথ্য সংবলিত পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে করাপশন ইন মিডিয়ার জাওয়াদ নির্ঝরের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাজেদা আক্তার নামের এক নারী সাংবাদিক মামলাটি দায়ের করেন। বিদেশ থেকে অপপ্রচার চালানো ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে। সর্বশেষ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের প্রধান বনজ কুমারের বিরুদ্ধে অনলাইনে অপপ্রচার চালানোয় তার বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়।
সূত্র মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গুজব চক্র ফের সক্রিয় হচ্ছে। নিয়মিতভাবে এসব চক্র রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পুলিশপ্রধানসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাল্পনিক তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কানাডা থেকে নাসমুস সাকিব ও টিটো রহমানের পরিচালিত ইউটিউবভিত্তিক নাগরিক টিভিতে কয়েকদিন আগে একটি কন্টেন্ট প্রচার করা হয়। ওই কন্টেন্টের শিরোনাম ছিল ‘অঘটন ঘটিয়ে দেশ ছাড়তে পারেন শেখ হাসিনা।’ এছাড়াও একসময় দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কর্মরত থাকা ইলিয়াস হোসাইনও তাঁর ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ‘সেন্টমার্টিনে নির্বাসিত হচ্ছে শেখ হাসিনা’ শিরোনামে একটি ভুয়া তথ্য দিয়ে তিনি তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
জানা গেছে, কথিত সাংবাদিকরা যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করার পরিকল্পনা নেয় প্রথমে তাদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টেমপ্লেট প্রচার করে। পরে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের ই-মেইলের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংবেদনশীল বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়। কখনো আবার এসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কাছে চাঁদা দাবি করে চক্রটি। চাঁদা না পেলে পরবর্তীতে চক্রটি বিভিন্ন গাল-গল্প মিশিয়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। আবার অনেক সময় নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শের বিপরীত মেরুতে থাকা ব্যক্তিদের নিয়েও অপপ্রচার করে এসব চক্র।
সূত্র জানায়, আলোচিত নুসরাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুর পর বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগ উঠে নাসমুস সাকিব ও টিটো রহমানের বিরুদ্ধে। বসুন্ধরা এমডির কাছে পাঁচ কোটি টাকা চাঁদা দাবির একটি ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়। মূলত এরপরই নাসমুস সাকিব ও টিটো রহমানের চাঁদাবাজির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। মূলত দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে চাঁদা দাবি করে আসছে টিটো-সাকিব চক্র।
সম্প্রতি দুবাইয়ে একটি জুয়েলার্স দোকান খুলে আলোচনায় আসেন আরাভ খান নামের এক ব্যক্তি। এরপর দেশের গণমাধ্যমে আরাভ খানের অপকর্ম নিয়ে বেশকিছু সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেসময় আরাভ খান জুলকার নাইন সায়ের নামের একজনের বিরুদ্ধে চাঁদাদাবির অভিযোগ তুলেন।
সূত্র মতে, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি ১৫ জন সাইবার সন্ত্রাসীকে শনাক্ত করেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এসব ব্যক্তিরা বিদেশে বসে বাংলাদেশবিরোধী ভয়ংকর অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। চক্রটি রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানাভাবে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। এই তদন্তে নাজমুস সাকিবের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া গেছে। এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচার নজরদারি করে হালনাগাদ প্রতিবেদন তৈরি করছে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) কোর সাইবার টাস্কফোর্স (সিসিটিএফ) টিম। পাশাপাশি বিদেশ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারকারীদের নামের তালিকা হালনাগাদও করছে তারা। নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠকে এসব তথ্য জানিয়েছে এনটিএমসি। গত ২২ মার্চ অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
[caption id="attachment_214102" align="aligncenter" width="1024"] জুলকারনাইন সায়েরকে নিয়ে প্রকাশিত একটি ইংরেজি পত্রিকা থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট।[/caption]
উল্লেখ্য, জুলকারনাইন সায়েরের বিষয়ে অর্থপাচার মাদক চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা না হয়েও লেফট্যানেন্ট পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে আটক হওয়ারও তথ্য রয়েছে। ২০০০ সালে চুরির দায়ে আটক হয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। র্যাব কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ কেনে জুলকার নাইন সায়ের খান। ভুয়া চেকের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১। ১৯৮৬'র অক্টোবরে জন্ম নেয়া সায়ের খান ক্লাস এইটে থাকাকালে ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিস্কৃত হয়। কুমিল্লা ইস্পাহানি কলেজে থাকাকালিন নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। মেয়েদের উত্যক্ত করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। তখন থেকে স্বজন আর বন্ধুরা এড়িয়ে চলা শুরু করে তাকে।
এদিকে, ১৭ বছর বয়সে, ২০০০ সালে, ইসিবিতে কর্মরত মেজর ওয়াদুদের ট্র্যুকসুট চুরি করে ধরা পড়ে সায়ের খান। চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের অঙ্গনা জুয়েলার্সেও চোরাই হাতির দাঁত বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। সেনা কর্মকর্তা না হয়েও সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের ইউনিফর্ম পরতো সে। তবে সিএমএইচে মিলিটারি পুলিশের কাছে ধরা পড়ে জুলকারনাইন। অনিয়ন্ত্রিত জীবন আর উচ্ছৃঙ্খলতায় অতিষ্ট হয়ে, পুত্রকে ত্যাজ্য করেন সেনা কর্মকর্তা পিতা আব্দুল বাসেত। পরে ২০০৬ সালের ২৩শে জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি