তেল-গ্যাস সরবরাহ বাবদ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা সরকার আগামী দুই মাসের মধ্যে পরিশোধ করে ফেলবে জানিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখন প্রতি সপ্তাহে ৮ থেকে ৯ কোটি ডলার ছাড় করা হচ্ছে।
বুধবার জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস উপলক্ষে জ্বালানি মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক ওয়েবিনারে তিনি এমন আশাবাদের কথা শোনান।
এতে সচিব দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়া এবং আমদানি করা এলএনজিসহ দৈনিক ৩১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার তথ্যও দেন।
ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকটে পড়ে বেশ কিছুদিন থেকে জ্বালানি খাতে টানাটানি চলছে। ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার নীতিতে বেশ কিছুদিন ধরে চলছে সরকার। এতে চাহিদার তুলনায় তেল ও গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়।
এমন অবস্থার মধ্যে মাস কয়েক আগে সময়মতো জ্বালানি তেলের অর্থ পরিশোধ করতে না পারার খবর এসেছে। সময়মত বকেয়া পরিশোধ করতে না পারার কারণে আন্তর্জাতিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিলম্ব ফি দিতে হয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি)। ডলারের সংকটের কারণে চলতি বছরে একাধিকবার কয়লা আমদানি করা যায়নি; যাতে বন্ধ রাখা হয় দেশের প্রধান দুই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা ও রামপাল। দাম বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি কেনাও বন্ধ রেখেছিল সরকার।
এমন পরিস্থিতিতে ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সরবরাহ হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে এমন খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে বারবার। এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টে বৈদেশিক লেনদেনের প্রধান মুদ্রা ডলারের সংকট কেটে যাওয়ার সুখবর দিলেন জ্বালানি সচিব।
এদিন ওয়েবিনারের সভাপতির বক্তব্যে খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, মিডিয়ায় অনেক সময় খবর আসছে ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি খাতে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। জ্বালানি খাতে ডলার সংকট কেটে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি সপ্তাহে ৮০ থেকে ৯০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করা হচ্ছে। যে বকেয়া ছিল তা আগামী দুই মাসের মধ্যে পরিশোধ হয়ে যাবে।
গ্যাস পরিস্থিতির প্রসঙ্গে তিনি গত ১৫ বছরে দেশে বেশ কিছু নতুন কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়লেও কিছু পুরোনো কূপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এরমধ্যেও দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে বেড়ে ২২০০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে বলে জানান তিনি।
সচিব বলেন, এলএনজিসহ এখন দৈনিক ৩১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের বিডিংয়ে অংশ নিতে অনেক কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে।
সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় যুক্ত করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতে মানুষের জ্বালানি চাহিদা বিভিন্ন উৎস থেকে পূরণ হচ্ছে। ২০০৯ সালে যেখানে দেশের এলপিজির বার্ষিক সরবরাহ ৪৫ হাজার টন ছিল, সেখানে এ বাজার এখন বছরে ১৪ লাখ টনে পৌঁছেছে।
গ্যাসের ৪২ লাখ আবাসিক গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটারের আওতায় এনে অপচয় রোধ ও সাশ্রয় নিশ্চিত করতে সরকারের পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ৯ অগাস্ট তৎকালীন পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাশটিলা আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছ থেকে কিনে জাতীয়করণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে কূপ পরিচালনাকারী কোম্পানিও কিনে নিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তকে স্মরণ করে ২০০৯ সাল থেকে ৯ অগাস্টকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করছে সরকার।
এ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ওয়েবিনারে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ২০২৪ সালে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাবে। সেখানে হাজার হাজার বাংলাদেশি ছেলে-মেয়ে পারমাণবিক বিদ্যুতের বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ভবিষ্যতে তারাই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করবে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি বহুমুখীকরণের অংশ হিসেবে সরকার সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতেও গুরুত্ব দিচ্ছে। কক্সবাজারে ৬০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আশার আলো দেখাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও অফশোরে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া যায় কি না সেই চিন্তাভাবনা চলছে।
সাগরে গ্যাস উত্তোলনে বিদেশি কোম্পানির নতুন করে আগ্রহ দেখানোর বিষয়ে তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় অনেক ভূ-রাজনৈতিক ব্যাপার থাকে। আগে কনোকো ফিলিপ ও ফসকো দায়ুকে কাজ দেওয়া হয়। তারা মাঝপথে কাজ রেখে চলে গেছে। ভারতের ওএনজিসি এখন গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করছে। যারা চলে গেছে তারা ভূরাজনৈতিক কারণে চলে গেছে কি না বলা যাচ্ছে না।
জ্বালানির বর্তমান সংকটে বাংলাদেশের কোনো হাত ছিল না মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, জ্বালানি ও খাদ্যে ভূ রাজনৈতিক ইস্যু জড়িত থাকে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি, সারসহ সব পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে বাংলাদেশের বাড়তি আট বিলিয়ন ডলার বেশি খরচ হয়। অনেকটা ডাকাতির মতো করে তারা ডলারগুলো নিয়ে গেছে।
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে গেছেন বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, বঙ্গবন্ধু যে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নিয়েছেন তার বাজারমূল্যের চেয়ে অর্থনৈতিক মূল্য অনেক বেশি।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎখাতের সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যানের খসড়ায় তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক জ্বালানির বহুমুখীকরণ, পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো এবং কৃষি জমিকে বাঁচিয়ে যতটা সম্ভব সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, দেশব্যপী নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি তেল সরবরাহের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমানে ২৪টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ৯টিতে গ্যাস পাওয়া গেছে। চিত্রটি অনেক ভালো, তবে আরও ভালো হতে পারত।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক সাময়িকী এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ারের সম্পাদক মোল্লা আমজাদ হোসেন বাংলাদেশের বিশাল কয়লার মজুদ কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন।
অর্থসংবাদ/এসএম