ম্যাথিউ রিকার্ড একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। পরোপকার, পশু অধিকার, সুখ ও প্রজ্ঞা-সম্পর্কিত বই লেখেন তিনি। এসব বই আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক বিক্রির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। তাঁর মানবিক কর্মকাণ্ডের প্রচেষ্টার স্বীকৃতি তাঁর দেশ ফ্রান্স থেকে মিলেছে; ‘ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল অর্ডার অব মেরিটে’ ভূষিত হয়েছেন তিনি।
রিকার্ডের বাসস্থান একটি নেপালি মঠে। বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাই লামার ফরাসি দোভাষী ছিলেন তিনি। সেলুলার জেনেটিকসে পিএইচডি করেছেন। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দেখতে পান, রিকার্ডের মস্তিষ্ক থেকে ‘গামা তরঙ্গ’ তৈরি হয়, যা শিখন, মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে মাত্রায় ওই গামা তরঙ্গ তৈরি হয়, তার নিরিখে তাঁকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
রিকার্ড তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘চট করে নিরুৎসাহিত হবেন না।’ ‘নোটবুকস অব আ ওয়ান্ডারিং মঙ্ক’ নামের স্মৃতিকথাটি শিগগিরই বাজারে আসছে। তাঁর স্মৃতিকথায় বলা হয়েছে, ‘আপনি এখনই পিয়ানো বাজানো আয়ত্ত করতে পারবেন না। এই দক্ষতা অর্জনের জন্য সময় লাগে।’
এটা বলার জন্য মোটেও ভালো কথা নয়, তবে সহজেই কিন্তু আমরা কিছুসংখ্যক মানুষকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়টি কল্পনায় আনি। আমাদের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা মানুষের সঙ্গে আমরা কতটা সুন্দরভাবে মেলামেশা করতে পারি, যখন বিশ্বে বিপরীত মেরুর বা বিভাজনের ধারণা আরও পোক্ত হচ্ছে?
মানে, ভ্লাদিমির পুতিন যা চান, তা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দালাই লামা বলতে পারতেন, কিন্তু পুতিন এটা বলতে যাবেন না, ‘আপনার সহমর্মিতা আমাকে বদলে দিয়েছে।’ অনেক দিন আগে একজন আমাকে বলেছিল, ‘আপনি একাকী কার সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা কাটাতে চান?’ আমি বললাম, সাদ্দাম হোসেন। আমি আরও বললাম, ‘হয়তো, হয়তো তাঁর (সাদ্দাম হোসেন) মধ্যে সামান্য কিছু পরিবর্তন হতেও পারে।’
যখন আমরা সহমর্মিতার কথা বলি, তখন আপনি চান, সবাই যেন সুখ খুঁজে পায়। এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না। যাঁরা আপনার চোখে ভালো বা আপনার কাছের লোক যাঁরা, তাঁদের জন্য আপনি এটি শুধু করতে পারবেন না। এটি সর্বজনীন হতে হবে।
আপনি হয়তো বলতে পারেন যে পুতিন ও বাশার আল-আসাদ মানবতার পক্ষের লোক নন এবং এটা ঠিক কথাও বটে। কিন্তু সহানুভূতি বা সহমর্মিতা দুঃখ-কষ্টের লাঘব ঘটায় এবং দুঃখ-কষ্টের কারণেরও লাঘব ঘটায় সহমর্মিতা। ব্যাপারটা দেখতে কেমন? আমি কখনো কখনো মনশ্চক্ষে দেখতে পাই, ডোনাল্ড ট্রাম্প হাসপাতালে যাচ্ছেন, মানুষের সেবা করছেন, অভিবাসীদের তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। আপনি কামনা করতে পারেন, এসব মানুষের মন থেকে নিষ্ঠুরতা, উদাসীনতা, লোভ মুছে যাক; এটাই সহমর্মিতা, যা পক্ষপাতহীন।
কিন্তু সহমর্মিতাকে কেন সর্বজনীন হতে হবে? কারণ, এটি নৈতিক বিচার থেকে ভিন্ন। এটি আপনাকে বলতে বাধা দেয় না যে যাঁরা চলতে-ফিরতে থাকা সাইকোপ্যাথ বা মনোবিকারগ্রস্ত ব্যক্তি, তাঁদের হৃদয় নেই। কিন্তু সহানুভূতি বা সহমর্মিতা দুঃখ-কষ্টের লাঘব ঘটায়, তা সে দুঃখ-কষ্ট যেখানেরই হোক না কেন, যে রূপেই হোক না এবং এর কারণ যে-ই হোক না কেন, তাহলে এখানে সহমর্মিতার বিপরীতে কী? সেটা হলো ঘৃণা এবং এই ঘৃণার আওতায় থাকা ব্যক্তি।
কেউ যদি আপনাকে লাঠি দিয়ে পেটায়, আপনি লাঠির ওপর রাগ করবেন না, আপনি ওই ব্যক্তির ওপর রাগ করবেন। আমরা যাঁদের কথা বলছি, তাঁরা হাতের ওই লাঠির মতো, যার মধ্যে রয়েছে অজ্ঞতা ও বিদ্বেষ। আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো একজনের কর্মকাণ্ডের বিচার করতে পারি, কিন্তু সহমর্মিতা এই কামনা করে যে দুঃখ-কষ্টের বর্তমান অবস্থার পাশাপাশির এর কারণগুলোও যেন নির্মূল হয়।
ধরে নিচ্ছি, কিছু সময়ের জন্য লোকজন আপনাকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে ডাকল। আপনি কি এতে খুশি হবেন? এটা একটা বড় কৌতুক ছাড়া কিছু নয়। আমরা স্নায়ুবিজ্ঞানের মাধ্যমে সুখের মাত্রা জানতে পারি না। এটি সাংবাদিকদের ব্যবহার করার জন্য একটি ভালো শিরোনাম হতে পারে, কিন্তু আমি এটিকে এড়াতে পারি না। হয়তো আমার সমাধিতে লেখা থাকবে, ‘এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ঘুমিয়ে আছে।’
যা-ই হোক, আমি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করি। তবে অবশ্যই চরম দুঃখের মুহূর্তও আছে, বিশেষ করে যখন আপনি চারদিকে এত দুঃখ-কষ্ট-বিগ্রহ দেখেন। এবং এর মাধ্যমেই আপনার সহমর্মিতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে এবং যদি আপনার সহমর্মিতা জেগে ওঠে, তাহলে আপনি আরও স্বাস্থ্যকর, আরও অর্থপূর্ণ উপায়ে বাঁচতে শুরু করবেন।
একেই বলে সুখ। এটা এমন নয় যে আপনি আনন্দের জন্য সব সময় লম্ফঝম্ফ করেন। সুখ আপনার ভিত্তিভূমির মতো। অনেক উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনার পর আপনি সেখানে পা রেখেছেন। কাউকে কষ্ট পেতে দেখে আমরা আরও প্রচণ্ড খারাপ বোধ করি, তবে আমরা এই গভীরতর উপলব্ধি ধরে রাখি। এটা সম্ভব হয় ধ্যানের মাধ্যমে।
কিন্তু আমি যদি কাউকে এটা ব্যাখ্যা করি, তাঁরা বলতেই পারেন, ঠিক আছে, আমি কীভাবে বদলাব? এর উত্তর কি ‘শুধু সহমর্মিতা সম্পর্কে ভাবতে শুরু করুন’-এর মতো সহজ? আপনি যখন কাউকে নিঃশর্ত ভালোবাসার মুহূর্তে থাকেন, ধরুন, তা একটি শিশুর জন্য, তা কিন্তু আমাদের মনকে ৩০ সেকেন্ডের জন্য পূর্ণ করে রাখে, সম্ভবত তা মিনিটব্যাপী, তারপর হঠাৎ সেটা চলে যায়।
আমাদের সবারই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন ফারাকটা গড়ে দেবে, সেই অভিজ্ঞতাকে ভিন্নভাবে অনুশীলন করার মধ্য দিয়ে। এটাকে আরও কিছু বেশি সময় ধরে রাখার চেষ্টা করুন। ১০ মিনিটের জন্য, ২০ মিনিটের জন্য নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। যদি এটি চলেও যায়, ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন। এতে প্রাণবন্ততা যুক্ত করুন। এটাই করে থাকে ধ্যান। যদি আপনি প্রতিদিন ২০ মিনিটের জন্য এটা করেন এবং টানা তিন সপ্তাহ ধরে করতে থাকেন, তাহলে এটাই হয়ে উঠবে পরিবর্তনের ‘ট্রিগার’।
আড়াই হাজার বছরের চর্চিত বিজ্ঞানকে একটি একক বাক্যের ভেতর নামিয়ে আনার জন্য নয়; কিন্তু আপনি কি অন্যদের পরামর্শ দিতে পারেন না যে তাঁরা মনের ভেতর যা বহন করতে পারেন, তা তাঁদের জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার পক্ষে সহায়ক হতে পারে? যদি আপনি পারেন, যতটা সম্ভব আপনার পক্ষে, মানবীয় উষ্ণতার সেই গুণটি গড়ে তুলতে অনুশীলন করুন, প্রকৃতপক্ষের অন্যদের সুখী হিসেবে দেখতে চান; এটি আপনার নিজের সুখী হওয়ার সেরা উপায়।
এটি মনের সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক অবস্থাও বটে। স্বার্থপর ব্যক্তিরা যখন বলেন, ‘আপনি এটা করেন, কেননা আপনি এতে সুখ অনুভব করেন’, বিষয়টি খুবই স্থূলতার পরিচয় বহন করে। কেননা আপনি যদি কোনো কিছুর পরোয়া না করে অন্যকে সাহায্য করেন, তাহলে আপনি কিছুই অনুভব করবেন না! নিজের ভালো লাগা থেকে অন্যের জন্য আলাদা কিছু করতে চাওয়ার বিষয়টি এমন একটা শিখা তৈরির চেষ্টা, যা আলো ছড়ায়, কিন্তু তার তাপ নেই।
কিছুটা সুখ বোধ নিয়ে যদি আমরা আরও বিনম্রভাবে আমাদের কল্যাণকর কর্মকাণ্ড বাড়ানোর চেষ্টা করি, সেটাই হবে সুন্দর জীবনযাপনের সর্বোত্তম পন্থা। এর চেয়ে সেরা পরামর্শ আর কিছু হতে পারে না।
অর্থসংবাদ/এসএম