শেয়ারবাজারে মিয়া মামুনের আলাদিনের চেরাগ ‘মিনোরি’

শেয়ারবাজারে মিয়া মামুনের আলাদিনের চেরাগ ‘মিনোরি’
দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত দুটি কোম্পানির মালিকানায় এসেছে কথিত জাপানি একটি প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিগুলোর শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে মিনোরি বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠানটি দুই কোম্পানির মালিকানায় আসে। এ খবরসহ বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে মিয়া মামুন সিন্ডিকেট দুটি কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধিতে কারসাজি করেই যাচ্ছে। একটি কোম্পানির শেয়ার ৮ টাকা থেকে বেড়েছে ১৮২ টাকা পর্যন্ত। এখন অপর একটি কোম্পানির শেয়ারদর নিয়ে একই রকম ফাঁদ পেতেছে এই চক্রটি। ২৩ টাকা দরের শেয়ারটি ৪৩ টাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধরিয়ে দিয়ে ফের ২৫ টাকা করে কিনছে চক্রটি। আবারও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে বিভিন্ন মুখরোচক গালগল্প সাজিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। মিনোরি বাংলাদেশের মালিকানায় রয়েছেন জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি মিয়া মামুন। তাঁর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে একাধিক কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গুজব ছড়িয়ে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর আকাশচুম্বী করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। মিনোরিকে শেয়ারবাজারে আলাদিনের চেরাগ হিসেবে ব্যবহার করছেন মিয়া মামুন। অর্থসংবাদের অনুসন্ধানে মিয়া মামুন সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে। ধারবাহিক অনুসন্ধানের প্রথম পর্ব থাকছে আজ।

সূত্র মতে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং ফু-ওয়াং ফুড লিমিটেডের মালিকানায় যুক্ত হয়েছে মিনোরি বাংলাদেশ লিমিটেড। দুই কোম্পানির মালিকানায় মিনোরির যুক্ত হওয়ার খবরে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারদর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর মধ্যে এমারেল্ড অয়েলের কারখানাসহ সব সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বেসিক ব্যাংক নিলামে তুলেছে। ফলে সম্পদবিহীন কাগুজে কোম্পানিতে পরিণত হতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তবুও নিত্যনতুন গুজব ছড়িয়ে শেয়ারটির দর বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একইভাবে খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক খাতের কোম্পানি ফু-ওয়াং ফুডস নিয়েও কারসাজি করে যাচ্ছে মিয়া মামুন চক্র।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ওই বছর পুঁজিবাজারে ২ কোটি শেয়ার ইস্যু করে ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানটি। ধানের কুঁড়া থেকে তেল উৎপাদন ও বাজারজাত করে এমারেল্ডের স্পন্দন ব্র্যান্ড সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির মাত্র দুই বছর পরেই বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি মামলার কারণে ২০১৬ সালের ২৭ জুন থেকে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এ মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে যায় এমারেল্ডের মালিকপক্ষ।

সূত্র জানায়, এমারেল্ড অয়েলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং মালিকপক্ষের পালিয়ে যাওয়ার খবরের সুযোগ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে মিনোরি বাংলাদেশের মালিক মিয়া মামুন। ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর এমারেল্ড অয়েলের শেয়ার নিয়ে কারসাজির পরিকল্পনা। তখন থেকেই কম মূল্যে কিনতে থাকে এমারেল্ড অয়েলের শেয়ার। এক্ষেত্রে নিজের ঘনিষ্ঠজনদের ব্যবহার করেন মিয়া মামুন। বিভিন্ন নামে-বেনামে এমারেল্ড অয়েলের শেয়ার কেনা সম্পন্ন হলে শুরু করে কারসাজির দ্বিতীয় ধাপ।

দ্বিতীয় ধাপে কৌশলে জাপানের কোম্পানি মিনোরিকে যুক্ত করা হয় এমারেল্ড অয়েলের মালিকানায়। শেয়ারবাজারে এই তথ্যটি ছড়িয়ে কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয় কোম্পানিটির শেয়ারদর। কয়েক মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারদর প্রায় ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে- মূলত শেয়ার কারসাজি করতেই এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানায় এসেছে মিয়া মামুন।

জানা গেছে, এমারেল্ড অয়েলের সম্পদ নিলামে বিক্রি করতে বেসিক ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে অর্থঋণ আদালত। এর প্রেক্ষিতে একবার নিলামও করে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকটি। তবে কেউ নিলামে অংশ নেয়নি। ফলে আইন অনুযায়ী পুণরায় নিলাম করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বেসিক ব্যাংক। এরপরও এমারেল্ডের সম্পদ বিক্রি না করতে পারলে তা ভোগদখল করবে ব্যাংকটি।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি কোম্পানির কোন সম্পদ নেই জানা সত্ত্বেও কোম্পানিটি কেনার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে শেয়ারদর নিয়ে কারসাজি করা। তাঁরা বলছেন, মিনোরি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ছড়িয়ে ইতিমধ্যেই কোম্পানিটির শেয়ারদর আকাশচুম্বী করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মিয়া মামুন কোটি কোটি টাকা হাঁতিয়ে নিয়েছে। ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে এমারেল্ড অয়েলের ৮ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হলেও কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে নাম নেই মিয়া মামুনের। তাঁর দাবি- এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রির সিআইবি রিপোর্ট খারাপ হওয়ায় তিনি পর্ষদে যুক্ত হননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিয়া মামুন অর্থসংবাদকে বলেন, ২০২১ সালে এমারেল্ড অয়েলের মালিকানায় মিনোরি আসলেও আমি ২০১৮ সাল থেকেই যুক্ত। বেসিক ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করে নিলাম করেছে। ব্যাংকের সাথে আমার কথা হয়েছে। কিভাবে এমারেল্ড অয়েলের সম্পদ ফিরে পাওয়া যায় সে বিষয়ে আমি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি।

তবে মিয়া মামুনের এসব দাবি অস্বীকার করেছে বেসিক ব্যাংক। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অর্থসংবাদকে জানিয়েছেন, এমারেল্ড অয়েলের বর্তমান পর্ষদ তথা মিয়া মামুনের সঙ্গে বৈঠকের চেষ্টা করা হলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

বেসিক ব্যাংক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থসংবাদকে বলেন, এমারেল্ড অয়েলের নতুন পরিচালনা পর্ষদকে ঋণ পরিশোধে অগ্রসর হওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা হয়। বর্তমান পর্ষদ শর্ত দিয়েছে সুদ মওকুফ ও পুনঃতফসিলের আবেদন নিষ্পত্তি করতে। এমন অবস্থায় ব্যাংকের নিয়মাচার অনুযায়ী দলিলাদি সম্পাদন এবং সোলেনামার মাধ্যমে মামলা স্থগিতের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে আইনি জটিলতা নিরসনের জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে একাধিকবার প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে একাধিক চিঠি এবং আলোচনার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বর্তমান পর্ষদ প্রয়োজনীয় সহায়তা না করায় এবং আইনী জটিলতা থাকায় ঋণটি পুনঃতফসিল করা সম্ভব হয়নি।

মিয়া মামুন অর্থসংবাদের কাছে দাবি করেছেন, তিনি জাপানের টোকিওতে ‘এমারেল্ড অয়েল জাপান’ নামে কোম্পানিটির শাখা খুলেছেন। তিনি বলেন, জাপানে শাখা খোলার কারণে দেশটির ব্যবসায়ীদের কাছে সহজেই এমারেল্ড অয়েলের তেল বিক্রি করা যাবে। এক্ষেত্রে তেলের সব দায় এমারেল্ড অয়েল নেওয়ার কারণে এখানকার (জাপান) ব্যবসায়ীরা তেল কিনতে আগ্রহী হবে।

মিয়া মামুন নিজেও জানেন এমারেল্ড অয়েলের কোন সম্পদ থাকবে না। প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি কৌশল অবলম্বন করে বলেন, এমারেল্ড অয়েলের সব কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। জামালপুরে নতুন করে কারখানা স্থাপন করা হবে।

এদিকে এমারেল্ড অয়েলের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার পর নতুন করে ফু-ওয়াং ফুড নিয়ে খেলছে মিয়া মামুন চক্র। এক্ষেত্রেও জাপানি প্রতিষ্ঠান মিনোরি বাংলাদেশের বিনিয়োগের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। সম্প্রতি ফু-ওয়াং ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদেও যোগ দিয়েছেন আলোচিত মিয়া মামুন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ অর্থসংবাদকে বলেন, গুজব ছড়িয়ে এমারেল্ড অয়েল ও ফু-ওয়াং ফুডসহ কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে জুয়া খেলা হচ্ছে। না বুঝে এবং লোভে পড়ে কিছু মানুষ এসব শেয়ার কিনছে। লোভে পড়ে কেউ ফাঁদে পা দিলেই কারসাজি চক্র লাভবান হয়।

তিনি বলেন, এমারেল্ড অয়েলের মতো ঋণ জর্জরিত কোম্পানি কেউ কিনবে না। গালগল্প ছড়িয়ে এসব শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

মিয়া মামুনের জন্ম চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৮ সালে সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০০ সালে জাপানে পাঁড়ি জমান মিনোরির এই উদ্যোক্তা। ২০০৮ সালে পড়াশোনা শেষ করে তিন বছর চাকরি করেন। পরবর্তীতে জাপানে গড়ে তোলেন মিনোরি নামের কোম্পানি।

অর্থসংবাদ/ওয়ালিদ


আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

ফু-ওয়াং সিরামিকের লভ্যাংশ অনুমোদন
এক বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা
ডিএসইতে মোবাইল গ্রাহক-লেনদেন দুটোই কমেছে
বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন পেয়েছে ৯ কোম্পানি
পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ আজ
বছরের ব্যবধানে পুঁজিবাজারে লেনদেন বেড়েছে ৪০ শতাংশ
রবিবার পুঁজিবাজার বন্ধ থাকলেও চলবে দাপ্তরিক কার্যক্রম
লোকসানে ৮ খাতের বিনিয়োগকারীরা
সাপ্তাহিক রিটার্নে মুনাফায় ১০ খাতের বিনিয়োগকারীরা
খাতভিত্তিক লেনদেনের শীর্ষে প্রকৌশল খাত