গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত ‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক নেটিজেন ফোরামে বক্তারা এমন মতামত দেন। এই আলোচনায় সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক মূল প্রবন্ধে বলেন, উৎপাদনশীল কার্যক্রম ও প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক চিত্র দেখা গেছে। তবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার মানে শুধু প্রবৃদ্ধি নয়। প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে কি না, এটা জরুরি বিষয়। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো প্রবৃদ্ধির গুণগত মান নিশ্চিত করা এবং এর সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে কি না, তা দেখা।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘অর্থনীতিতে কিছু খাত পুনরুদ্ধার হচ্ছে, কিছু খাতে হচ্ছে না। আমরা কোন ধরনের পুনরুদ্ধারের কথা বলছি, এটা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সামাজিক পুনরুদ্ধারেও জোর দিতে হবে।
দেখতে হবে, দারিদ্র্যসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান খাতে যে অভিঘাত এসেছে, তার পুনরুদ্ধার হচ্ছে কি না।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘যারা কাজ হারিয়েছে, তাদের সহায়তা করার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সেটা অনেক ক্ষেত্রে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। মনে হচ্ছে, প্রবাসী আয়ের কারণে অনেক পরিবার বড় সংকট থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রবাসী আয় আনার অবৈধ পথ বন্ধ হয়েছে, এতে আয় বাড়ছে। ২ শতাংশ প্রণোদনাও কাজে দিয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়ছে। বাতিল হওয়া আদেশে আবার রপ্তানি হচ্ছে। সামনে কী হবে, তা নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।’
সেলিম রায়হান বলেন, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখছে কি না, এটা দেখতে হবে। এর প্রভাব সামষ্টিক অর্থনীতিতে দেখা গেলেও প্রান্তিক পর্যায় এবং খাতভিত্তিক ও সরবরাহব্যবস্থায় তা দৃশ্যমান নয়। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ঋণ ও আমদানি খাতের প্রবৃদ্ধি আশাবাদী হওয়ার মতো নয়।
আলোচনায় যোগ দিয়ে কলকাতা থেকে সুভিক মুখার্জি বলেন, ভারতে ‘ভি’ টাইপ পুনরুদ্ধার হবে না। ‘ইউ’ বা ‘ডব্লিউ’ টাইপ হতে পারে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সময় লাগবে। ভারতের ২০ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনার মধ্যে ৮ লাখ কোটি টাকাই রিজার্ভ ব্যাংকের।
সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বলেন, উৎপাদন ও জাতীয় আয়ে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে পোশাক খাত ও প্রবাসী আয়ের। এ দুটো সূচক এখন পর্যন্ত ইতিবাচক। মার্চ-মে সময়ের চেয়ে বর্তমানে উৎপাদন কার্যক্রমে ইতিবাচক চিত্র দেখা যাচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ক্ষেত্রে সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানে বেশি নজর দিতে হবে। মানুষের প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ের জন্য সব সূচককে গুরুত্ব দিতে হবে।
সায়মা হক আরও বলেন, করোনাভাইরাসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভারতের চেয়ে ভালো হয়েছে। এ নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। সময়মতো প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। প্রবাসী আয় বাড়ছে, তা গ্রামীণ অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে ভূমিকা রাখছে। কৃষি খাত সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এতে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ হলো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এতে বাংলাদেশের পাশাপাশি সহযোগী অনেক দেশ ক্ষতিতে পড়তে পারে।
সায়মা হক বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। সে জন্য এই সহায়তা কতটা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা দেখতে হবে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ও ব্যবসায়ীদের আস্থা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। করোনা সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত চিহ্নিত করে প্রণোদনার আওতায় আনতে হবে।
বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে সেলিম রায়হান বলেন, আয় কমে যাওয়ায় পরিবারগুলো এখন খরচ সমন্বয় করছে, অনেক কিছু ছাড় দিচ্ছে। অনেকে বাচ্চাদের স্কুল থেকে ফেরত এনে কাজে লাগাচ্ছেন। তাঁদের অনেকে হয়তো আর কখনোই স্কুলে যাবে না। আবার যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদেরও খরচ বেড়েছে। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। ছোটদের প্রণোদনা তহবিলের ৫ ভাগের ১ ভাগও বিতরিত হয়নি। প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে সমস্যা রয়েছে। এই প্যাকেজ কতটা কাজে লাগল, সরকারি পক্ষ থেকে তা জরিপ হওয়া প্রয়োজন।
সেলিম রায়হান বলেন, এটা স্বীকার করে নিতে হবে যে প্রবৃদ্ধি ৩-৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে। যদি স্থানীয় অর্থনীতি ভালো পুনরুদ্ধার না হয়, আবার ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, তাহলে বড় প্রশ্ন উঠবে।
অনুষ্ঠানে সানেমের গবেষক মাহতাব উদ্দিন অনানুষ্ঠানিক খাতকে আনুষ্ঠানিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এ বিষয়ে কিছু মাত্রায় নীতিমালা শিথিল করা প্রয়োজন। যাতে অনানুষ্ঠানিক খাত আনুষ্ঠানিক খাতে অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহ পায়।
তবে এ জন্য যথাযথ পরিকল্পনা প্রয়োজন, অপরিকল্পিত অন্তর্ভুক্তি কাম্য নয়।
ফোরামের অংশগ্রহণকারীরা কৃষি খাতের বর্তমান অবস্থা এবং এর গতিমুখ এবং শিল্প খাতের নানা আঙ্গিক নিয়েও আলোচনা করেন।