জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ-২০২০’ উপলক্ষে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে দেয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
বিশেষ অধিবেশন উপলক্ষে নতুন সাজে সাজানো হয়েছে সংসদকে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অধিবেশন প্রত্যক্ষ করার জন্য আমন্ত্রণ পান এবং অনেকে যোগও দেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোর, যৌবন, শিক্ষা, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পর সরকারসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর আলোকপাত করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রায় সময় বঙ্গবন্ধুই স্পিকারকে বলে সে সুযোগ করে দিতেন। বিরোধী দলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা একটা মনোযোগ ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। রাজনৈতিক মতাদর্শের যত অমিলই থাকুক না কেন বঙ্গবন্ধু কখনো বিরোধী দলের নেতাদের কটাক্ষ করে কিছু বলতেন না বরং তাদের যথাযথ সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। রাজনৈতিক শিষ্টাচার তার জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর থাবায় গোটাবিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যাও প্রায় পাঁচ কোটি। এখনও মৃত্যু ও আক্রান্তের মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে শত শত মানুষ। বাংলাদেশেও করোনায় কেড়ে নিয়েছে ছয় হাজারের অধিক অমূল্য প্রাণ।
রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করছি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে, যিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম অবদান রেখেছেন এবং আমৃত্যু বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। করোনাকালে আমরা আরও হারিয়েছি সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, বেগম সাহারা খাতুন, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাকে।
এছাড়া হারিয়েছি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, বিশিষ্ট আইনজীবী ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের অনেক ব্যক্তিকে। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করছি।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে ইতিহাস, ইতিহাসের পরম্পরা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার নিভৃতপল্লী টুঙ্গীপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলা কেটেছে গ্রামের কাদাজল, মেঠোপথ আর প্রকৃতির খোলামেলা পরিবেশে। পরোপকার আর অন্যের দুঃখকষ্ট লাঘবে সবসময় তিনি নিজেকে জড়িয়ে নিতেন। নিজের সুখ-দুঃখের কথা না ভেবে অন্যকে নিয়ে ভাবতেন। সেই থেকে শুরু। জীবনের প্রতিটি ক্ষণে যেখানেই অন্যায়-অবিচার, শোষণ-নির্যাতন দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদে নেমে পড়েছেন। কখনো নিজের এবং পরিবারের গণ্ডির মধ্যে বাঁধা পড়েননি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও গেয়েছেন বাংলা, বাঙালি আর বাংলাদেশের জয়গান। ফাঁসির সেলের পাশেই কবর খোঁড়া হচ্ছে জেনেও বাঙালির স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল ও অনড়। আজীবন বাংলা ও বাঙালিকে ভালোবেসে গেছেন, স্থান করে নিয়েছেন মানুষের মনের মণিকোঠায়।
তিনি আরও বলেন, ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মানবদরদী কিন্তু অধিকার আদায়ে আপসহীন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ব্রিটিশবিরোধী সভা-সমাবেশে অংশ নেন তিনি। গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গড়ে তোলেন ‘মুসলিম সেবা সমিতি’। ১৯৩৮ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ঘটে এবং প্রথম পরিচয়েই তিনি নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। সোহরাওয়ার্দীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমেই রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি। তারপর থেকে লেখাপড়া, রাজনীতি ও জনসেবা যুগপৎভাবে চলতে থাকে। ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তারপর ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। অবিভক্ত বাংলার রাজনীতি থেকে পূর্ববাংলার রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। দেশবিভাগের কিছুদিন পরই তরুণ নেতা শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশ পরাধীনতার কবল থেকে মুক্তি পেলেও বাঙালি নতুন করে পশ্চিমাদের শোষণের কবলে পড়েছে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী প্রথম আঘাত হানে বাঙালির মায়ের ভাষা ‘বাংলা’র ওপর। ঘোষণা দেয় ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ শেখ মুজিব সচিবালয় গেট থেকে গ্রেফতার হন। অর্থাৎ পাকিস্তান কায়েম হওয়ার আট মাসের মধ্যেই তিনি কারাবরণ করেন।
১৯৪৯ সালে ১৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সহযোগিতা ও সমর্থন দেয়ার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। মুচলেকা দিয়ে অনেকে ছাত্রত্ব ফিরে পেলেও তিনি সে পথে পা বাড়াননি, তিনি ছিলেন আপসহীন। যেখানেই অন্যায়-অবিচার, শোষণ-নির্যাতন দেখেছেন সেখানেই তিনি প্রতিবাদে নেমে পড়েছেন। জীবনে কখনো নীতি-আদর্শের সঙ্গে আপস করেননি। ভাষার দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে আটকাবস্থায় হাসপাতালে থেকেই ছাত্রনেতাদের সাথে গোপনে বৈঠক করে একুশে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন।
তিনি বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম ও কারাভোগের মধ্য দিয়েই শেখ মুজিব বাঙালির অধিকার আদায়ের পথে এগিয়ে চলেন। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি ৩৩ বছর বয়সে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে গোপালগঞ্জ থেকে প্রথমবারের মতো আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১৫ মে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সমবায়, ঋণ ও গ্রামীণ পুনর্গঠন বিষয়কমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেয় এবং অন্য রাজনীতিবিদদের সাথে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন।
আবদুল হামিদ বলেন, ১৯৫৫ সালের ৫ জুন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসলিম লীগের হয়ে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তান গণপরিষদে ভাষণদানকালে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামের বিরোধিতা করে ‘পূর্ববাংলা’ করার আহ্বান জানান। একই ভাষণে আঞ্চলিক ও স্বায়ত্তশাসনেরও দাবি জানান। ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জোট সরকারের শিল্প-বাণিজ্য-শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন এবং ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৭ সালের ৩০ মে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বার্থে জোট সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। দলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর কতটা আনুগত্য, আন্তরিকতা ও টান ছিল মন্ত্রিপরিষদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ক্ষমতা বা কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়া বঙ্গবন্ধুকে তার লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত করতে পারেনি- এটাও তার একটি বড় প্রমাণ।
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু দুই বছর কারাভোগ করেন এবং ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে আবারও গ্রেফতার হন। কিন্তু কোনো কিছুই শেখ মুজিবকে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে পারেনি। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরে ঐতিহাসিক ৬ দফা উত্থাপনের পর প্রথম তিন মাসেই পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাকে আটবার গ্রেফতার করে। জেল থেকে বের হয়েই বঙ্গবন্ধু ৬ দফার সমর্থনে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেড়ান। জেল-জুলুম কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যদিও সামরিক সরকার ৬ দফা নিয়ে জনমত গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে অধিকাংশ সময় বঙ্গবন্ধুকে কারান্তরীণ রাখে।
রাষ্ট্রপতি হামিদ আরও বলেন, বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে প্রতিহত করতে সামরিক সরকার কারান্তরীণ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে ৩৫ জন বাঙালির বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ শীর্ষক মামলা দায়ের করে, যা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। সামরিক সরকারের এহেন অগণতান্ত্রিক, নিপীড়ন ও নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণ রুখে দাঁড়ায়। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। দেশব্যাপী সৃষ্টি হয় গণঅভ্যুত্থান। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সামরিক শাসক ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলায় আটক শেখ মুজিবসহ অন্য বন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখো ছাত্র-জনতার সংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়। এই সমাবেশেই তিনি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।