বাজারে বারবার একটা গুজব ছাড়ানো হয়েছে করোনা বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকার ছুটি ঘোষণা করবে এবং পুঁজিবাজার বন্ধ হয়ে যাবে, যা একেবারেই সত্য নয়। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় প্রেস রিলিজের মাধ্যমে এ গুজবকে খন্ডন করেছেন। বিএসইসি’র চেয়ারম্যান সু-ষ্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন কোন কারণেই পুঁজিবাজার বন্ধ থাকবে না। যতদিন ব্যাংক ব্যবস্থা চালু থাকবে ততদিন পুঁজিবাজার চালু থাকবে। এর কোন ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু ইতিমধ্যেই গুজবের কারণে বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী এই গুজবে প্রভাবিত হয়ে তাদের শেয়ার panic sell করেছেন। যাতে করে মূলতঃ বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এখন সেই গুজবের প্রভাব কাটিয়ে, বাজারের উপর আস্থা রেখে আবার বিনিয়োগ শুরু করেছেন। আমাদেরকে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, গুজব নির্ভর বাজারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হন বিনিয়োগকারীরা। অতএব, বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করার পূর্বে (যারা ভাল মৌলভিত্তিক শেয়ার হোল্ড করছেন) দশবার চিন্তা করতে হবে কেন বিক্রি করবেন।
আমি বিশ্বাস করি, যেসব বিনিয়োগকারী ভাল মৌলভিত্তিক কোম্পানিতে ইনভেস্ট করেছেন, ভালভাবে কোম্পানি বিশ্লেষণ করেছেন তাঁদের লাভলোকসান নিয়ে ভাবার কোন দরকার নাই। বাজারে শেয়ারের দাম উঠানামা করবে এটাই স্বাভাবিক। ভালো মৌলভিত্তিক শেয়ার যদি আপনার হাতে থাকে, একটু বেশি দামেও যদি কিনে থাকেন এবং যদি ধরে রাখতে পারেন, সেই শেয়ারে আপনি কখনো লোকসান করবেন না, ইনশআল্লাহ।
আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের চরিত্রটা যদি যাচাই করি তাহলে আমরা দেখি একটি গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করে বিনিয়োগকারীকে প্রতারিত করে। মৌলিক শেয়ারের দাম যখন স্থির থাকে, তখন ঐ সকল দুষ্ট চক্রের হাতে কোনো শেয়ার না থাকার কারণে তারা কিভাবে শেয়ারের দাম কমিয়ে শেয়ার ক্রয় করবে সেই চেষ্টা করে।তারা অনেক সময় সফল হয়ে যান। যারা ভাল মৌলভিত্তিক শেয়ার কিনে হোল্ড করতেন তারা প্রভাবিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন। অপরদিকে, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুঁজিবাজারের এই দুষ্ট চক্রটি সিরিয়াল বাণিজ্য, বিজ্ঞপ্তি বাণিজ্য, বাজারের কারসাজি এর মাধ্যমে, অনেক সময় স্পনসর, পরিচালক, প্রচারক, পরিচালনা এর সাথে মার্কেট ম্যানিপুলেট করে, বিভিন্ন রিউমার ছড়িয়ে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঐসব কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের জন্য বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করে ফেলেন। বিনিয়োগকারীরা যখন তাদের ফাঁদে পা দিয়ে ঐসব শেয়ার কিনেন তখন তারা সাংঘাতিকভাবে প্রতারিত হয়।
আমি দৃড়ভাবে বলতে চাই গতকাল ডিএসই’র “স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী: বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আলোকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের অর্জন ও সম্ভাবনা” অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী, বিএসইসির চেয়ারম্যান, সচিব, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, সু-ষ্পষ্টভাবে পুঁজিবাজারকে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার মধ্যে রেখে ভাল ভাল প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে যা কিছু করার সেগুলো চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু ইক্যুইটি মার্কেট নয়, বন্ড, সুকুক, ইসলমিক বন্ড, ইটিএফ, স্মি, ট্রেজারি-বন্ড, এটিবি, ওটিসি যেগুলো বাজারে চালু করার জন্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা আরও ত্বরান্বিত করার তাগিদ দেন।ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও বেক্সিমকোর বন্ড অনুমোদন দিয়েছেন। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেজারি-বন্ড ট্রেড করার সব পদক্ষেপ নিয়েছেন। মিউনিসিপ্যাল বন্ড নিয়ে আসার জোড় প্রচেষ্টা চলছে। বিদেশী অনেক কোম্পানি বন্ড ছাড়ার জন্য এগিয়ে আসছে যারা পরবর্তীতে তালিকাভুক্ত হবে। বন্ড মার্কেটে যাতে সহজে ট্রেড করা যায় এবং এর অপারেশন যাতে সিম্পল হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় রুলস/রেগুলেশনস প্রণয়ন ও সংশোধন করা হয়েছে।
মিউচ্যুয়াল ফান্ড বাজারকে শক্তিশালী করে এবং মার্কেট মেকার হিসাবে কাজ করে। মিউচ্যুয়াল ফান্ড সেক্টরকে শক্তিশালী করা হচ্ছে তারা যাতে ভাল মৌলভিত্তিক শেয়ারে ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে বাজারকে সাপোর্ট দিতে পারে তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) মার্কেট মেকার হিসেবে কাজ করতে হবে। আইসিবির সঠিক ভূমিকা হচ্ছে মার্কেটকে স্থিতিশীল করা। পুঁজি বাজারের উন্নয়নে আইসিবিকে বাজার নির্মাতার ভুমিকা পালন করতে হবে। অপরদিকে, পুঁজিবাজারে যাতে ভাল ভাল প্রতিষ্ঠান (লোকাল ও আন্তর্জাতিক) আসতে পারে তার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। বিদেশীরা যাতে সহজে বাজারে ইনভেস্ট করতে পারেন এবং সহজে তাঁদের লাভের অংশ repatriate করতে পারেন তার সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ভুল থেকে বেরিয়ে পুঁজিবাজারকে গতিশীল করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। যা পুঁজি বাজার উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক দিক। লিস্টেড ও নন-লিস্টেড কোম্পানির মধ্যে কর্পোরেট ট্যাক্স এর ব্যবধান কমপক্ষে ১৫% করতে হবে যাতে ভাল মৌল ভিত্তিক বড় ফার্ম পূঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে আরও উৎসাহ পায়।
অর্থ মন্ত্রনালয় (এমওএফ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সবাই চায় পুঁজিবাজার যেন স্থিতিশীল হয়, যেন পার্টিসিপেশন বাড়ে, তার জন্য সকল ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।বিদ্যমান সকল লিস্টেড কোম্পানিতে ভাল কর্পোরেট সংস্কৃতি, ভাল কর্পোরেট প্রশাসন আনার সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ওটিসি মার্কেট থেকে ভাল ভাল কোম্পানিকে মেইন মার্কেটে আনা হচ্ছে। ছোট পরিশোধিত কোম্পানিকে ঠিকানা করা হচ্ছে। যে সকল কোম্পানিতে স্পনসর, পরিচালক, প্রচারকরা ৩০% হোল্ড করেন না সেসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনগঠন করতে বিএসইসি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করছে।
মার্কেট মেকার অ্যাক্ট করা হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে মার্কেট মেকার license দেয়া শুরু হয়েছে। কোম্পানি buy-back আইন করার জোড় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সবাই কাজ করছে, FRC active হচ্ছে, যারা ভুল অডিট রিপোর্ট দিবে তাদেরকে আইন এর আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। যারা সিরিয়াল বাণিজ্য, বিজ্ঞপ্তি বাণিজ্য, বাজারের কারসাজি করবে তাদেরকে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। বাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বাজার পরিচালনায় বিএসইসি এর মাননীয় চেয়ারম্যান PROS শিবলি রুবাইয়াত-উল-ইসলাম শূন্য সহনশীলতায় আছেন। তিনি বারবার একটি ম্যাসেজ সবাইকে দিয়ে যাচ্ছেন কোথাও কোন অনিয়ম উনি সহ্য করবেন না, তিনি যত শক্তিশালী হোক না কেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বাজারকে গতিশীল করতে ইক্যুইটি মার্কেট এর পাশাপাশি বন্ড, সুকুক, ইসলমিক বন্ড, ইটিএফ, স্মি, ট্রেজারি-বন্ড, এটিবি, ওটিসি এসব এনে বাজারকে আর গতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং সফলতা অর্জন করতে যাচ্ছেন। যে সকল কোম্পানিতে স্পন্সর ডিরেক্টর ৩০% শেয়ার হোল্ড করেনা, তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। যেসব কোম্পানির পরিচালকেরা দীর্ঘ দিন বোনাস দিয়ে শেয়ারের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছেন, সিরিয়াল বাণিজ্য, বিজ্ঞপ্তি বাণিজ্য, বাজারের কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন, তাদেরকে কোম্পানির ৭০% শেয়ার কমপক্ষে ফেইস ভ্যালুতে কিনতে হবে। তাঁরা যদি শেয়ার কিনতে ব্যর্থ হন তাহলে তাঁদেরকে ম্যানেজমেন্ট থেকে সরিয়ে দিতে হবে এবং দক্ষ ও ডায়নামিক প্রফেশনালস নিয়োগ দিতে হবে।
ভুল তথ্য, মিথ্যা তথ্য, অতিরিক্ত মূল্যায়ন রাতারাতি বাজারে আসার আগে কোম্পানীর EPS বেড়ে যাওয়া, পন্যের বিক্রি বেড়ে যাওয়া, reserve বেড়ে যাওয়া, কোম্পানীর উত্পাদনশীল পন্যের মজুত বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি দেখিয়ে কোম্পানিকে বিনিয়োগকারীর নিকট আকর্ষণীয় করে মার্কেটে শেয়ার বিক্রি করতে দেয়া যাবে না। বিগত দিনে যেসব কোম্পানি এসব কাজের সাথে জড়িত ছিল তাঁদেরকে শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাঁদের কোন অধিকার নাই এই মার্কেটে থাকার।
আমি দৃড়ভাবে বিশ্বস করি, একজন সুশিক্ষিত বিনিয়োগকারী হিসাবে আমি সঠিক বিচার-বিবেচনা করে আমার বিনিয়োগ করব, কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শেয়ার বেচাকেনা করবো না। যারা বাজারে রিউমার ছড়িয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তাদের কথায় কান দেব না, প্রয়োজনে রেগুলেটরি অথরিটির সাথে যোগাযোগ করব এবং তাঁদেরকে শনাক্ত করব।
আমাদের সবাইকে ধৈর্য্য ধরতে হবে এবং সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। হতাশ হবেন না, রিউমার প্রত্যাখ্যান করুন, অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শেয়ার কেনাবেচা করবেন না। আপনার বিনিয়োগ আপনি করুন। নিজের বিচার বিশ্লেষণ দিয়ে ভাল শেয়ার কিনুন, রিউমার-হিউমার এর উপর ভিত্তি করে শেয়ার কেনাবেচা করবেন না। লোভে পড়ে বিনিয়োগ করবেন না, তাড়াহুড়া করবেন না, সকল পদক্ষেপ সতর্কতার সাথে নিবেন। সবাই মার্কেটের জন্য কাজ করছে, মার্কেটে নতুন নতুন অপশন আসছে যেমনঃ বন্ড, সুকুক, ইসলমিক বন্ড, ইটিএফ, স্মি, টি-বন্ড, এটিবি, ওটিসি ইত্যাদি, আপনার বিনিয়োগের জন্য নতুন নতুন উইন্ডো খোলা হচ্ছে যা আপনাকে বিনিয়োগের জন্য আরও উজ্জীবিত করবে। বাজার সঠিক পথে আছে এবং এভাবে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ৫০০০ কোটি টাকা ট্রেডের যে স্বপ্ন তা আগামী ৩ বছরের মধ্যেই বাস্তবায়ন হবে, ইনশাআল্লাহ।
মোঃ রকিবুর রহমান
সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড