বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে ‘কোভিড-১৯: চ্যালেঞ্জেস ফর দ্য রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি সারভাইভারস’ শীর্ষক এক আলোচনায় জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে বক্তব্য দেন সাংসদ শিরীন আখতার, একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক হামিদা হোসেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এদেশীয় পরিচালক টুমো পোটিয়াইনেন প্রমুখ। ওই ভবনধসের ঘটনায় ১ হাজার ৪০০ আহত শ্রমিকের মধ্যে ২০০ জন টেলিফোনে জরিপে অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ পুরুষ ও ৬৩ শতাংশ নারী।
ভবনধসে আহত পোশাকশ্রমিকদের মধ্যে ২০১৯ সালে বেকার ছিলেন ৫১ শতাংশ। গত বছর করোনাকালে সেটি বেড়ে ৫৭ শতাংশ হয়েছে, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আহতদের মধ্যে কাজে আছেন ৪৩ শতাংশ। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ পোশাক কারখানায় কাজ করেন। এর বাইরে ১২ শতাংশ দরজি দোকানে, ৩ শতাংশ কৃষি খাতে, আড়াই শতাংশ দিনমজুরি, ২ শতাংশ গৃহকাজে নিয়োজিত। এ ছাড়া সাড়ে ৩ শতাংশ বিক্রয়কর্মী হিসেবে এবং ৭ শতাংশ অন্যান্য কাজ করেন।
একশনএইডের জরিপ বলছে, সাভারের রানা প্লাজা ধসে আহত সাড়ে ১০ শতাংশের আয় ৫ হাজার ৩০০ টাকার নিচে। সাড়ে ৩৭ শতাংশ আহত শ্রমিকের আয় ৫ হাজার ৩০০ থেকে ১০ হাজার ৩০০ টাকা। সাড়ে ২৯ শতাংশ শ্রমিকের আয় ১০ হাজার ৩০১ থেকে ১৫ হাজার ৩০০ টাকা। এর চেয়ে বেশি আয় ১৩ শতাংশের।
জরিপমতে, আহত শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ শ্রমিক করোনাকালে অল্প কিছু সরকারি সহায়তা পেয়েছেন। আর ৯২ শতাংশই কোনো সরকারি সহায়তা পাননি। প্রাণে বেঁচে যাওয়া এসব শ্রমিক দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। ১৪ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। তাঁরা মাথা, হাত, পা, ও কোমরের ব্যথায় ভুগছেন। সাড়ে ৫৮ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্য মোটামুটি স্থিতিশীল। তবে সাড়ে ২৭ শতাংশ সম্পূর্ণ ভালো আছেন।
আবার সাড়ে ১২ শতাংশ আহত শ্রমিক মানসিক ট্রমার মধ্যে রয়েছেন। এ হার ২০১৯ সালে ছিল সাড়ে ১০ শতাংশ। তার মানে গত বছর নতুন ২ শতাংশ শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। আবার গত বছর ৬২ শতাংশ শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্য মোটামুটি স্থিতিশীল ও সাড়ে ২৫ শতাংশের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো ছিল। এ হার ২০১৯ সালে ছিল ২১ শতাংশ।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, আট বছরেও বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের অবস্থা দুঃখজনক। অথচ শ্রমিকদের দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের অক্সিজেন বলা হয়। ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি পূরণ করতে হবে।
আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য কার্ড দেওয়ার পরামর্শ দেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ভবনধসের পর আট বছরেও শ্রমিকদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। কর্মক্ষেত্রেও তাঁদের নিশ্চয়তা দেওয়া যায়নি।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা কমিটি ও স্বাস্থ্যবিমা কার্যকর করার মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানান শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের আহ্বায়ক হামিদা হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের কবরস্থানে যাই। জায়গা দিন দিন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এখানে শ্রমিকদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ হওয়ার কথা ছিল। বাস্তবে হয়নি। শ্রমিকদের কবর চিহ্নিত করতে প্রতিবছর সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়েও কাজ হচ্ছে না।’
এ ছাড়া আহত ও নিহত শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল, সেটাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিও দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ আদালতে পড়ে আছে বলে উল্লেখ করেন হামিদা হোসেন।
দেশে শ্রম আইনের প্রয়োগ হলে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা আদায় করা সম্ভব হতো বলে মন্তব্য করেন সাংসদ শিরীন আখতার। তিনি বলেন, শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণে আইন স্বচ্ছভাবে করা প্রয়োজন। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে অবশ্যই শ্রমিকদের অধিকার, মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা, বিমা, স্বাস্থ্য কার্ডসহ আপত্কালীন তহবিল গঠন করতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, এস অলিভার ব্র্যান্ডের কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম প্রমুখ।