টিকার জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব

টিকার জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব
করোনার টিকা যতদিন না হবে, ততদিন একের পর এক ঢেউ আসতে থাকবে।এ লক্ষ্যে আগামী বাজেটে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহি পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।

মঙ্গলবার (৪ মে) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সহযোগিতায় এক বাজেট আলোচনার আয়োজন করে হিসাববিদদের প্রতিষ্ঠান দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)।এ আলোচানায় তিনি এসব কথা বলেন।

এছাড়াও তিনি বাজেটে ঘাটতি সাত থেকে আট শতাংশ করা, আদায়যোগ্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা, প্রণোদনায় এসএমই খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। আগামী বাজেটে করোনার টিকাকে গুরুত্ব দেওয়ারও আহ্বান জানান।

‘সামষ্টিক অর্থনীতি : ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রত্যাশা’ শীর্ষক ওই আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান।এছাড়া আইসিএবি’র প্রেসিডেন্ট মাহমুদুল হাসান খসরুর সভাপতিত্বে এতে অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীরা নেতারা আগামী বাজেট নিয়ে তাদের প্রত্যাশা তুলে ধরেন।

আসন্ন বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা জিডিপির হিসাবের চাইতে করোনা মোবাবেলাকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এছাড়া ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা, কর্মসংস্থানমুখী বাজেট প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। আজ মঙ্গলবার এক বাজেট আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন।

আলোচনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো ও তা যথাযথভাবে ব্যয় করা, ভোক্তার চাহিদা ধরে রাখা, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনকে গুরুত্ব দেওয়া, অর্থনীতিতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত টিকা কার্যক্রমকে গতিশীল করা এবং দেশের বেশিরভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনা, কর কাঠামোর ব্যপক সংস্কার, করহার কমানো, ধনীদের ওপর বাড়তি কর আরোপ করার প্রস্তাবও উঠে আসে।

এদিকে আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যবসায়ী নেতা ও বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) চেয়ারম্যান আবুল কাশেম খান ভোক্তার ব্যয় বা ভোগ ব্যয় ধরে রাখতে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ভোগ পড়ে গেলে উৎপাদন কমে যাবে, ফলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এজন্য ভোগ ব্যয়কে উৎসাহিত করতে বাজেটে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

গবেষনা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কালো টাকার সুযোগ দেওয়ায় ১২ হাজার কোটি টাকা অর্থনীতিতে আসছে। কিন্তু এর ফলে নিরুৎসাহিত হয়ে কী পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, তা হিসাব করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। বাজেট বিশেষত স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো, বিদেশী সহায়তা কাজে লাগানো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিভিন্ন বিভাগের সংস্কার কার্যক্রমকে দ্রুততর করা, পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান আগামী তিন বছরে কোম্পানির করহার ধাপে ধাপে সাড়ে সাত শতাংশ কমানোর প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, এটি কমানোর পর যে করহার হবে, তাও বৈশি^ক গড় কর্পোরেট হারের তুলনায় বেশি। এছাড়া কালো টাকা বিনিয়োগের বিদ্যমান বৈষম্য তুলে ধরে তিনি বলেন, চলতি অর্থবছর এ পর্যন্ত ১২ হাজার কোটি কালো টাকা সাদা হয়েছে। এখান থেকে সরকার কর পেয়েছে মাত্র ১২০ কোটি টাকা। ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো সাদা করা ঠিক হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি যদি ৩২ শতাংশ কর দিই, তাহলে কালো টাকার ক্ষেত্রে এর ওপর আরো ১০ শতাংশ জরিমানা থাকতে হবে। নাহলে আমরা আগামীতে কর দেওয়া বন্ধ করে দেব।

এছাড়া অবৈধ পথের আয়কে বৈধ না করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দয়া করে চুরি ডাকাতির ডাকাকে সাদা করবেন না। এতে কেউ সমর্থন দেবেন না। ঢালাও সব খাতে কালো বিনিয়োগের সুযোগ না দিয়ে স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগে গুরুত্ব দেন তিনি।

মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়ায় অসন্তোষের কথা জানান মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি ব্যরিস্টার নিহাদ কবীর। তিনি বলেন, ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা হচ্ছে। আর অর্থমন্ত্রী বলছেন, এতে অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার তো সেটা ভালো লাগে না। কারন আমি সাড়ে ৩২ শতাংশ কর দিই। তিনি বলেন, আমরা আমরা যখন কর ব্যবস্থাপনার সংস্কার নিয়ে কথা বলি, সেটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কিন্তু সেটা না করে কেউ কেউ আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা আমাদের বৈধ আয় কোথায় ব্যয় করবো, সেটা নিয়ে অন্যদের কথা না বললেও চলবে।

এসময় দেশের টাকা বিদেশে পাচাই ইস্যুতেও কথা বলেন নিহাদ কবীর। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের সহযোগিতায় যারা দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের দিকে নজর দেওয়া দরকার।

আইসিএবি’র প্রেসিডেন্ট মাহমুদুল হাসান খসরু দেশে জিডিপির তুলনায় রাজস্বের হার কম হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে এনবিআরের সঙ্গে আইসিএবির সহযোগিতার বিষয়টি উল্লেখ করে কোম্পানির নিরীক্ষিত প্রতিবেদন যাচাইয়ের (ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম বা ডিভিএস) বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তুলে ধরেন।

এ সময় ড. মসিউর রহমান কর ব্যবস্থায় সংস্কারে গুরুত্ব দেন। এছাড়া বাজেট বাস্তবায়নে স্থানীয় পর্যায়ের পরিবর্তে বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নেওয়া, ঘাটতি অর্থায়ন বাড়ানো এবং এ লক্ষ্যে বিদেশী উৎস থেকে তহবিলের যোগান দেওয়ার উপর গুরুত্ব দেন।

সাবকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দেওয়া এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে করহার কমানোর প্রস্তাব দেন।

আইসিএবি কাউন্সিল মেম্বার মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দীণ বলেন, চলমান কোভিড কালীন সময়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে। অর্থনীতিতে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে, তা মোকাবেলায় পলিসিগত সাপোর্ট বড়াতে হবে। লিস্টিড কোম্পানী থেকে করপোরেট কর অনেক বেশি আসছে। ক্যপিটাল মার্কেট ভাল থাকলে এই কর আরো বাড়বে। কোম্পানীগুলোকে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। ফলে সম্পদের সুষম বন্টনের সম্ভব হবে। কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য নতুন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ বড়াতে হবে। স্বচ্ছ্য, প্রযুক্তি ও কমসংস্থান এই তিনটির দিকে নজর দিতে হবে- অথনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য।

আইসিএবি ভাইস প্রেসিডেন্ট মারিয়া হাওলাদার বলেন, নারী উদ্যোক্তা বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা থাকতে হবে বাজেটে। নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। গত বছর প্রনোদনা প্যাকেজের ৯৪ শতাংশ পুরুষদের জন্য আর বাকি ৬ শতাংশ নারীদের জন্য। এটা স্পস্ট বৈষম্য। নারী উন্নয়নের অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি সেল খোলা যেতে পারে। আন্ত-মন্ত্রণালয় কার্যাবলী ও স্বচ্ছতার পাশাপাশি নারী উন্নয়নের বিশেষ খাতভিত্তিক বরাদ্দর আহবান জানান তিনি ।

আইসিএবি প্রেসিডেন্ট মাহমুদুল হাসান খসরু বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অনেক সূচক এখনো নীচের দিকে। একটি অনিশ্চয়তা রয়েছে সমগ্র দেশের অর্থনীতিতে। ক্ষতি মোকাবেলা করার জন্য অর্থনীতিতে তারল্য প্রবাহ বাড়িয়ে সরকার ২১-২২ অর্থ বছরে ব্যয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে । তিনি আরো বলেন, বাজেট থেকে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তিনি বলেন উচ্চতর করপোরেট টেক্স বিদেশী বিনিযোগ বাধাগ্রস্ত করবে। তাই করপোরেট টেক্স কমানো দরকার।

আইসিএবি ও ইকোনোমিক রিপোর্টারস ফোরামের ভার্চুয়াল বাজেট আলোচনাটি সঞ্চালন করেন আইসিএবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট ও কাউন্সিল মেম্বার মো. হুমায়ুন কবীর

আলোচনায় অন্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন আইসিএবি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট সিদ্ধার্থ বড়–য়া, মো. আব্দুল কাদের জোয়াদ্দার, আইসিএবি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশীষ বসু, গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষনা পরিষদের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিাসার্স ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) প্রেসিডেন্ট রূপালী হক চৌধুরী, দৈনিক প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন মাসুম, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি শারমিন রিনভী ও সাধারন সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য দেন।

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

নতুন সুদহার নির্ধারণ করল বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহারে ধ্বংস হচ্ছে জুয়েলারি শিল্প
বছর ঘুরলেও প্রবাসী আয়ে গতি ফিরেনি
বাংলাদেশি টাকায় আজকের মুদ্রা বিনিময় হার
গ্রাহক সংখ্যায় দেশসেরা প্রতিষ্ঠান নগদ
বছরজুড়ে আলোচনায় খেলাপি ঋণ, সুদহার ও বিনিময়হার
প্রথম দিনেই ২ লাখের বেশি পণ্যের অর্ডার পেলো ইভ্যালি
তিন মাসের মধ্যে সব দেনা পরিশোধ শুরু করবো
পোশাকশিল্পকে রাজনৈতিক হাতিয়ার না বানানোর অনুরোধ
এক মাসের ব্যবধানে আলুর দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ