ভাইরাস সংক্রমণে প্রায় তিন মাস ভয়ানক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে এক কোটি ১০ লাখ বাসিন্দার শহর উহান। পুরো সময়টা বাকি বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে ছিল তারা। লকডাউন ওঠায় দীর্ঘদিন বন্দিদশায় কাটানো উহানের বাসিন্দারা এখন নিজেদের অভিজ্ঞতা বলতে শুরু করেছেন। খবর বিডিনিউজের।
মাস্ক পরিহিত এক নারী বিবিসিকে বলেন, আমি আশা করি, মানুষ উহান থেকে শিখবে। কারণ অন্যদের এতটা মূল্য দিতে হয়নি এবং অন্যরা কেউ এত বড় ভুল করেনি। আমরা সবাই তখনই ভালো থাকব যখন বিশ্ব এই মহামারী থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেওয়া নভেল করোনাভাইরাসের কেন্দ্র হওয়ায় উহানের প্রতি নজর ছিল পুরো বিশ্বের।
গত জানুয়ারিতে শহরের মেয়র স্বীকার করেন যে, ভাইরাসটির সম্পর্কে দ্রুত তথ্য প্রকাশ না করে কর্মকর্তারা বড় ভুল করে ফেলেছেন। বিশ্বজুড়ে ৮০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ভাইরাসটির ঝুঁকি সম্পর্কে প্রথম দিকে অন্ধকারে থাকতে হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন উহানের বাসিন্দারা। এই প্রাদুর্ভাবকে গুরুত্ব না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে উহান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ভাইরাসটির ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে চেয়েছিলেন যে চিকিৎসকরা তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, একজন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন বলে খবর প্রকাশ হয়েছে।
এই রাখঢাকের সবচেয়ে ভয়ানক পরিণতি যেটা ছিল, ২২ জানুয়ারি উহানের বাসিন্দারা কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার আগে ৫০ লাখের মতো মানুষ সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে। এই ঘটনাই ভাইরাসটিকে পুরো চীন ও বিশ্বজুড়ে বয়ে নিয়ে যায়। ওই শহরে আটকে পড়ারা এখন জানাচ্ছেন লকডাউন পরিস্থিতির কষ্ট সম্পর্কে। তারাও স্বীকার করেছেন, প্রথম দিকে তাদের কোনোভাবেই মনে হয়নি রোগটির প্রার্দুভাব এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।
একজন নারী বলেন, একটা বড় সময়ের জন্য উহান অবরুদ্ধ ছিল। প্রথম দিকে আমি এ বিষয়ে উদাসীন ছিলাম এবং লকডাউন দরকার বলে মনে করিনি। কিন্তু কিছু দিন পরেই জিনিসপত্রের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিল। চরম ভয় হচ্ছিল এবং আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না।
যখন হাসপাতালে একের পর এক রোগী মারা যাচ্ছে তখন চিকিৎসা সরঞ্জামের জন্য চিকিৎসকরা কীভাবে অনলাইনে আবেদন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা জানিয়েছেন আরেকজন নারী। কেউ কেউ শুনিয়েছেন লকডাউনের মধ্যে খাবারের খোঁজে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার কাহিনী। আবার কেউ শুনিয়েছেন অবরুদ্ধ দশা পরস্পারিক সম্পর্কে কী প্রভাব ফেলেছিল।
এক ব্যক্তি বলেন, মাসের পর মাস স্বামী-স্ত্রীর ২৪ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকাটা খুবই বিরল ঘটনা। তখন একজনের ভুল-ত্রুটি আরেকজনের সামনে চলে আসে। এ সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে ঝগড়া করা থেকে বিরত থেকে শান্তভাবে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পরামর্শ দেন তিনি।
উহানের আরেকজন নারী বলেন, লকডাউন আপনার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া নয়, এটা একটা সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মহামারী থেকে বেরিয়ে এসেছে উহান, সেই সঙ্গে সঙ্গে চীনও। যখন ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন চীন এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসছে।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মতে, এখন বিশ্বে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি, মৃত্যু হয়েছে ৮১ হাজারের বেশি মানুষের। চীনের জাতীয় হেলথ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার তাদের দেশে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা ৩২ জন, আগের দিন সোমবার ছিল ৩৯।
উহানে নতুন করে সংক্রমণ ধরা পড়ছে না বলে তথ্য দিয়েছে গার্ডিয়ান। কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার পঞ্চম দিনের মতো নতুন করে কারও এই ভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েনি শহরটিতে। চীন সরকারের তথ্য মতে, তাদের দেশে এই ভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮১ হাজার ৭৪০ জন। আর মারা গেছেন তিন হাজার ৩৩১ জন।