এবিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেন, আমরা যখন দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির কমিশনারের নেতৃত্বে বাজার নিয়ে আলোচনা করেছেন তারা। আমরা ভেবেছিলাম ভালো কিছু খবর পেতে যাচ্ছি। তার ভিত্তিতে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. শামসুদ্দিন আহম্মেদ বলেছেন, আমাদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে এবং নীতিগতভাবে আমরা একমত হয়েছি। আশা করি সবকিছু ঠিকমত হবে। এটি শেয়ারবাজারের জন্য একটি ভালো দিক। পরেরদিন বুধবার (১ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সাক্ষাত হয়। সেখানে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগকারীদের সাথে আছেন এবং শেয়ারবাজার ধরে রাখার জন্য তিনি সব ধরনের সহযোগীতা করার কথা বলেছেন। এছাড়া কোন আইনগত সমস্যা থাকলেও সমাধান করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ও অর্থনীতির জন্য এটা খুবই ইতিবাচক দিক।
তিনি আরও বলেন, কিন্ত বুধবার (১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যার দিকে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই ধরনের কোন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নেয়নি এবং বিএসইসির কমিশনার যা বলেছেন তা ঠিক নয়। আমার প্রশ্ন হলো: দুটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আলোচনা করলো এবং বললো যে আমাদের আলোচনা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। কিন্ত লিখিতভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে কোন পত্রিকায় কি লিখলো, এসব মৌখিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে সেটি শেয়ারবাজারের খুবই নেতিবাচক। যখন প্রধানমন্ত্রী সহ সবাই বাজারকে উদ্ধার করে ভালো অবস্থানে নিতে চাচ্ছেন, এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্যটি শেয়ারবাজারের জন্য ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মৌখিকভাবে যে আলোচনা হয়েছে তা আবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। আমি মনে করি এটি শেয়ারবাজারের জন্য একটি নেতিবাচক দিক বহন করেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন বক্তব্যটি দিলেন তার পরে এই ধরনের বক্তব্য কোন অবস্থাতেই ঠিক না। কারণ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে কোন কোন ক্ষেত্রে এটি সাংঘর্ষিক। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় সর্বাত্মক সহযোগীতা করার কথা। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ধরনের কার্যকলাপ খুবই অনাকাঙ্খিত ঘটনা। একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতা থাকলেও প্রেক্ষাপট চিন্তা করে সবক্ষেত্রে সবকিছু করা ঠিক না। আশা করি একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে আরও দায়িত্বশীলভাবে তাদের বক্তব্য এবং মন্তব্য করবে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম অর্থসংবাদকে বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে বুধবার (১ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তটির মাধ্যমে সব বিষয়ে স্পষ্ট করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, দেশের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) একইভাবে কাজ করছে। শেয়ারবাজারের উন্নয়ন হলে দেশের উন্নয়ন হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি সমন্বিতভাবে কাজ করবে। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকলাপ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাংঘর্ষিক কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে কি বলেছেন তা আমি জানি না। তবে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই চূড়ান্ত।
জানতে চাইলে ড. মিজানুর রহমান আরও বলেন, এছাড়া অর্থনৈতিক প্রয়োজন এবং শেয়ারবাজার ঠিক রাখতে দরকার হলে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করা উচিত। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অর্থ এই নয় যে, তারা যখন যা ইচ্ছে বলতে ও করতে পারবেন। যদি দেখা যায় শেয়ারবাজারের উন্নয়ন ও বিকাশে আইন যদি বাধাগ্রস্থ করে তাহলে এই আইন সংশোধন করতে হবে। আমি আশা করবো অত্যান্ত সংবেদনশীল শেয়ারবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কোন মন্তব্য করা ও পদক্ষেপ নেওয়ার আগে আরও বেশি চিন্তা করবে। এছাড়া আমি মনে করি তারা যেটা বলেছেন তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথাে সাংঘর্ষীক। আশা করি ভবিষ্যতে এই ধরনের বক্তব্য থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিরত থাকবে এবং শেয়ারবাজার ও দেশের সামগ্রীক উন্নয়নে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে।
শেয়ারবাজারে সূচকের উত্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, শেয়ারবাজার অনেক বিষয়ের সাথে জড়িত। শেয়ারবাজারে প্রতিটি ঘটনারই প্রভাব থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক যখন লিখিতভাবে তাদের একটি বক্তব্য প্রকাশ করলো এবং তারপরেই সকালে অর্থমন্ত্রণালয়ের খবরটি পেলাম। অর্থমন্ত্রণালয় বিএসইসির সাথে বৈঠক করতে যাচ্ছে আগামী ৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ ব্যাংকের খবরটি ছিলো শেয়ারবাজারের জন্য নেতিবাচক। আবার একইসাথে অর্থমন্ত্রণালয়ের খবরটি বাজারের জন্য ইতিবাচক। শেয়ারবাজারের উপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকান্ড উপযোগী না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই অবস্থান পুঁজিবাজারের জন্য প্রতিকূল অস্থায় রয়েছে। তাই তারা যে সিদ্ধান্তগুলো দিয়েছে তাতে হয়তো তাদের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। তবে সবকিছু মিলিয়ে বাজারের সূচক যে অবস্থানে রয়েছে সেখানে থাকার কথা না, এই সূচক আরও উপরে থাকা দরকার। বিনিয়োগকারীরা অনুভব করেছে যে, প্রধানমন্ত্রী যেখানে পাশে থাকার নিশ্চয়তা দিয়েছেন সেখানে অন্য কোন ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি বললো বা না বললো সেটা হয়তো তাদের বিবেচনা মূখ্য না।
এবিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ অর্থসংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের থেকে এটি আমরা আশা করিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে এরকম বৈঠক আগেও হয়েছে। এরপরে অর্থ মন্ত্রণালয় যেহেতু বৈঠক ডেকেছে। আশা করছি সেখানে এসব বিষয়ে আলোচনা এবং ফাইনাল সিদ্ধান্ত হবে। এক্সপোজার লিমিট কস্ট প্রাইজে ধরবে নাকি মার্কেট প্রাইজে ধরবে এটিই আলোচনার মূখ্য বিষয়। আমি মনে করি কস্ট প্রাইজে ধরা ঠিক। তারা বিশ্বের অন্য শেয়ারবাজারগুলোও দেখতে পারে। কারণ বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বড় অবদান রয়েছে। সেটার পরিমাণ এবং কিভাবে গণনা করে তা দেখতে পারে। গত বছর করোনার মধ্যে সূচক যখন পড়তে শুরু করলো তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংকগুলোকে শেয়ার ক্রয় করতে নির্দেশ দিয়েছিলো। এসময় প্রথমে সরকারি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কারণ সরকারি ব্যাংকগুলো শেয়ার ক্রয় করলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও ক্রয় করা শুরু করবে। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তিতে ২০০ কোটি টাকার ফান্ড অনুমোদন দেওয়া হয়। আমি আশা করি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগীতা করা উচিত।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী অর্থসংবাদকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আলোচনা ভালো ছিলো। বিএসইসি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। শেয়ারবাজারে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বিনিয়োগকারীদের হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেটা সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই চূড়ান্ত হবে।
এবিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি এ কে এম মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী অর্থসংবাদকে বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় শেয়ারবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং ক্যাপিটাল মার্কেটের বিপক্ষে গিয়েছে। তারঁ মতে- কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময় শেয়ারবাজারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিতেই এসব প্রশ্নবিদ্ধ কার্যকলাপ করছে।সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির কারণে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়। মঙ্গলবারের (৩০ নভেম্বর) বৈঠক শেষে বিএসইসি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফলপ্রসূ আলোচনার’ কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে। অথচ বুধবারের বড় উত্থানের দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। এতে বৃহস্পতিবার লেনদেনের শুরুতেই পতন লক্ষ্য করা গেছে। পরে অবশ্যই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের খবরে বাজারে বড় উত্থান হয়েছে।
মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী আরও বলেন, অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন যখন শেয়ারবাজারের উন্নয়নে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক তখন ক্যাপিটাল মার্কেট এবং দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য কাজ করছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগকারীদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন, ক্যাপিটাল মার্কেটের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার কথা জানিয়েছেন সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ। বিনিয়োগকারী পরিষদের সভাপতি মনে করেন- প্রধানমন্ত্রী এবং বিএসইসির বর্তমান কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন কার্যক্রম। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত না হয়ে নির্ভয়ে বিনিয়োগের আহ্বান জানান মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী।