জানা যায়, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িত রয়েছেন ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেময়েত উল্লাহ এবং পরিচালক এম এ খালেক। তারা যৌথভাবে এই টাকা আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট পক্ষটি নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য জাল নথি পর্যন্ত তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটির মালিকপক্ষ ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। একই সাথে টাকাগুলো তারা বিদেশে পাচার করেছে। তারা তিনজন যৌথভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। তবে আন্যরাও জড়িত থাকতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, ফারইস্ট লাইফের বিরুদ্ধে বিএসইসি একটি তদন্ত করেছে। সেখানে বড় ধরণের অনিয়ম ধরা পড়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি ইতোমধ্যে আরও কিছু নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দেওয়া হয়েছে। মালিকদের অপকর্মের কারণে গত ৯ আগস্ট কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কোম্পানিটিতে ১০ জন স্বতন্ত্র পরিচালক দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে সকল লেনদেনকে সুস্পষ্ট মানি লন্ডারিং অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়, সিআইডি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে দিয়েছে।
জানা যায়, ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকার মধ্যে ৮৫৪ কোটি টাকা বেআইনি জমি অধিগ্রহণ, তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৬৫৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা এবং কোম্পানিগুলোর মুদারাবা মেয়াদী আমানতের বিপরীতে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ৪২১ কোটি টাকা এবং দুটি ভূয়া সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ১৯২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে মালিকরা।
ফারইস্ট লাইফ ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মাঝে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে মোট ৩৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা আমানত রাখে। এর বিপরীতে উদ্যোক্তা এমএ খালেক ৩১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ঋণ নেন এবং তিনি খেলাপি হন। পরে ওই তিন ব্যাংক ফারইস্ট লাইফের আমানত দ্বারা ওই ঋণ সমন্বয় করেছে।
বিএসইসির প্রতিবেদনে এসব ঘটনায় ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, উদ্যোক্তা এমএ খালেক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ এনেছে। এতে বলা হয়েছে, তাদের পারস্পরিক যোগসাজশ ও পরিকল্পনার অর্থ লোপাট হয়েছে। অস্বাভাবিক দামে জমি কেনাবেচার বাইরে তারা নিজেদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে শত শত কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটির নামে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে মোট ১৩টি মুদারাবা মেয়াদী আমানত (এমটিডিআর)। এগুলো ছিলো পরিচালকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এই হিসাব খোলার জন্য তারা পর্ষদ সভার রেজুলেশন জাল করেছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটির পরিচালকরা ব্যাংকগুলো থেকে অনৈতিক ঋণ সুবিধা নিয়েছে। এর জন্য সহযোগিতা করেছে কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যখন তারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, ওই সময়ে ব্যাংকগুলো মুদারাবা মেয়াদী আমানত (এমটিডিআর) বাতিল করে দেয়৷
যেমন, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ফারইস্টের গচ্ছিত আমানতকে তৃতীয় পক্ষের জামানত হিসেবে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থসংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠান পিএফআই সিকিউরিটিজের নামে ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ১৩৬ কোটি টাকা ঋণ নেন এমএ খালেক। ব্রোকারেজ হাউসটি ঋণ পরিশোধ না করায় ফারইস্ট লাইফের আমানত থেকে ১৮৫ কোটি টাকা কেটে নিয়েছে ব্যাংক।
একইভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এমএ খালেকের প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি, পিএফআই প্রপার্টিস, মিথিলা টেক্সটাইল, মিথিলা প্রপার্টিস এবং আজাদ অটোমোবাইলসের নামে নেওয়া ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েও তা পরিশোধ করেনি। কিন্তু এসব ঋণের বিপরীতে ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল এবং ইউনিয়ন ব্যাংক ফারইস্ট লাইফের আমানত থেকে ২৯৩ কোটি টাকা সুদে-আসলে কেটে নিয়েছে। এভাবে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ঋণের জামানত দিয়ে সেই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে ব্যাংকগুলো বীমা কোম্পানিটির আমানত থেকে অর্থ কেটে নিয়েছে। এভাবে ফারইস্টের মোট লোকসান হয়েছে ৯৭৭ কোটি টাকার বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই টাকা ৩০ জুন,২০২১ পর্যন্ত সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করলে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মুনাফা পেত। সেই হিসেবে কোন ধনরণের ঝুঁকি ছাড়া এই টাকার পরিমাণ হতো ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছে। তার মেয়াদে ধারাবাহিক আর্থিক অপরাধ এবং অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। সাবেক পর্ষদ কোম্পানির নামে ১২টি জায়গায় জমি ক্রয় করেছে। প্রত্যেকটি জায়গা অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে ক্রয় করেছে। এর মাধ্যমে মোট ৮৫৮ কোটি টাকা আত্মসাত করেছে।
এদিকে ২০১৫ সালে ১২ মে কোম্পানি সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম তার শ্বশুর মোঃ মফিজুল ইসলাম ও শ্যালক মোঃ সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে ২৮ দশমিক ৫০ ডিসিমেল জমি ক্রয় করেছে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭২ কোটি টাকা। অথচ ২০১৪ সালের ৮ জুলাই তারা এই জমি মাত্র ১৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় ক্রয় করেছে বলেও বিএসইসির প্রতিবেদনে উঠে এসছে।
জমি কেনাবেচার মাধ্যমে চেয়ারম্যানের শ্বশুর ও শ্যালক ১৯৮ কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যক্তিগতভাবে লাভ করেন। ফারইস্ট লাইফের কাছ থেকে দাম বুঝে পাওয়ার পরই উপহার হিসেবে ১১৫ কোটি টাকা নজরুল ইসলামের স্ত্রী তসলিমা ইসলামের অ্যাকাউন্টে জমা দেন। আবার তসলিমা ইসলামও তার স্বামীকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন। বিশাল অঙ্কের এ উপহারের তথ্য তারা ওই বছরের আয়কর নথিতেও উল্লেখ করেন।
এছাড়াও, ২০১৪ সালের ৩ মার্চ নজরুল ইসলামের দুই ভাই আজহার খান ও সোহেল খানের কাছ থেকে একটি পুরানো ভবনসহ ৩৩.৫৬ ডেসিমেল জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও তারা নজরুল ইসলামের ব্যবসায়িক অংশীদার। এর জন্য ব্যয় ধরা হয় ২০৭.৩৬ কোটি টাকা।কিন্তু ২০১৪ সালের শুরুতে আজহার খান ১২.৮৫ কোটি টাকায় ১৫.৩ ডেসিমেল এবং মোঃ সোহেল খান ৮.৭০ কোটি টাকায় বাকী ১৮.২৬ ডেসিমেল জমি ক্রয় করে। এই জমি তারা ফারইস্ট লাইফের কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করেছে।
বিএসইসি প্রতিবেদনে বলা হয়, দুটি সংশ্লিষ্ট পক্ষের লেনদেনের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ৪০৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা নিজের করে নিয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। এই টাকা তিনি দেশের বাহিরে পাচার করেছে।