তবে খোদ গার্মেন্টস মালিকরাই বলছেন, স্বাস্থ্য নির্দেশিকা পুরোপুরি মেনে গার্মেন্টস চালানো সম্ভব নয়। কারণ, স্বাস্থ্য নির্দেশিকা পুরোপুরি মানতে গেলে শ্রমিকদের নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখতে হবে। অর্থাৎ আগের সিট প্ল্যান চেঞ্জ করতে হবে। কারখানার সব মেশিন খুলে নতুন করে স্থাপন করতে হবে। আর স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে নতুন করে মেশিন স্থাপন করতে হলে অন্তত ১৬ লাখ শ্রমিককে ছাঁটাই করতে হবে। এছাড়া এই মুহূর্তে শ্রমিকদের সুরক্ষা দিয়ে কারখানার ভেতরে তাদের থাকার ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়।
তিন ফিট দূরত্বের নিয়ম মানে না কেউ
সুইং বা সেলাই: পরপর মেশিনগুলো যেভাবে বসানো থাকে, তাতে দু'জন শ্রমিকের মধ্যে দূরত্ব মাত্র দেড় ফুট। আর পাশাপাশি দুই টেবিলের মাঝে গ্যাপ থাকে মাত্র ১২ থেকে ১৫ ইঞ্চি। প্রতিটি সেলাই মেশিন লম্বায় ২৮ ইঞ্চির মতো হয়। ফলে কারখানাগুলোতে প্রতি ৩০ থেকে ৩২ ইঞ্চির মধ্যে দুজন কখনও কখনও ৪ জন শ্রমিকও বসেন।
কাটিং: যেখানে শ্রমিকরা কাটিং করে, সেখানে তারা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ায়। এখানেও দুজন শ্রমিকের মধ্যে দূরত্ব দেড় ফুটের মতোই। কখনও দেড় ফুটের চেয়েও কম। একইভাবে ফিনিশিংয়ের স্থানও আগের তুলনায় দ্বিগুণ বড় করতে হবে। আয়রন করার ক্ষেত্রেও কিছুটা দূরত্ব বাড়াতে হবে।
মাস্ক পরতে খামখেয়ালি: এমনিতেই মানসম্মত মাস্ক নেই। তারপর অনেক শ্রমিক খামখেয়ালি করে কারখানার ভেতরে মাস্ক পরেন না। অনেকেই ভেতরে প্রবেশের পর মাস্ক খুলে রাখে। আর শ্রমিকরা অপুষ্টিতে ভোগার কারণে সব সময়ই তাদের ঠাণ্ডা-কাশি লেগেই থাকে। ফলে শ্রমিক অর্ধেক কমানোর পরও একজন থেকে আরেকজনে ভাইরাসের সংক্রমণের শঙ্কা থেকেই যায়।
টয়লেট ব্যবহার: কারখানার শ্রমিকরা গণ টয়লেট ব্যবহার করেন। প্রতিদিন একই টয়লেট দেড় থেকে দুইশ' মানুষ ব্যবহার করেন। কাজেই বাথরুম থেকেও হতে পারে করোনার সংক্রমণ। এ কারণে বাথরুম বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাথরুম পরিষ্কারের জন্য কর্মচারী বাড়াতে হবে।
আরও যেসব গুরুত্বহীন দূরত্ব: শ্রমিকরা যখন কারখানায় প্রবেশ করেন, তখন একসঙ্গে একই সময়ে একই গেট দিয়ে বা সিঁড়ি দিয়ে পাঁচ হাজার শ্রমিকের সবাই প্রবেশ করে। তিন ফুট দূরত্ব মানতে হলে লাইন ধরে প্রবেশ করতে হবে। দেখা যাবে, প্রবেশ করতেই তাদের দুই ঘণ্টা শেষ। একইভাবে কারখানা ছুটি হলে সবাই একসঙ্গে গা ঘেঁষে নামার চেষ্টা করে। এছাড়া শ্রমিকরা যখন খেতে বসে, এক সঙ্গে একহাজার বা তারও বেশি শ্রমিক গা ঘেঁষে বসে। কারখানার ভেতরে একই গ্লাস দিয়ে শত শত শ্রমিক পানি পান করেন। একসঙ্গে সবাই নাস্তা বা টিফিন খায়।
কাপড়ের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে করোনা: একটি জামা বা পেন্ট তৈরি করতে ৩০ থেকে ৭৫ জন ব্যক্তির হাত হয়ে তারপর শেষ হয়। ফলে ৭৫ জনের কোনও একজনের থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। যে কারণে সবার জন্য হ্যান্ড গ্লাভস জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো কোনও কারখানার মালিকই এই হ্যান্ড গ্লাভস দেন না।
সাবান দিয়ে হাত ধুতেও আলসেমি: কারখানাগুলোতে প্রবেশের সময় সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার রেওয়াজ থাকলেও পরে আর হাত ধোয়ার বালাই নেই। শ্রমিকরাই বলছেন, প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর হাত ধোয়া সম্ভব নয়।
আরও যে সব ঝুঁকি: কারখানার ফ্লোর এবং বাথরুম স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিষ্কার রাখতে হবে। কারখানায় লাইন ধরে একজনের সঙ্গে আরেকজনের দূরত্ব তিন ফুট ব্যবধান রেখে প্রবেশ ও বের হতে হবে। তবে কারখানার ভেতরে সব ঠিকঠাক করার পরও ঝুঁকি থাকবেই। কারণ, শ্রমিকরা কারখানার বাইরে যখন থাকে, তখন বাজার করবে, খাওয়া-দাওয়া করবে। যেখানে থাকবে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে মিশবে। একই রান্না ঘরে একাধিক পরিবার খাবার তৈরি করবে। এছাড়া স্ত্রী কারখানার শ্রমিক আর স্বামী রিকশা চালক, এক্ষেত্রেও ঝুঁকি থেকে যায়।
এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. জাহিদ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে না পারলে কোনও কারখানা খুলতে দেওয়া উচিত না। কারণ, করোনাভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ গার্মেন্টস শ্রমিকরা। কারখানা থেকে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে, আবার বাসা থেকেও ছড়াতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস খোলার কোনও যৌক্তিকতা নেই।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, কারখানা খোলা রাখতে হলে দু'জন শ্রমিকের মধ্যে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্বের বিষয়টি পরিপালন করতে হবে। দূরত্ব ৬ ফুট হলে ভালো হয়। আর তিন ফুটের মধ্যে দুটি মেশিন থাকলে গ্যাপ দিয়ে দিয়ে বসতে হবে। শুধু মেশিনই নয়, প্রবেশ ও বের হওয়ার ক্ষেত্রেও তিন ফুট দূরত্ব মানতে হবে। ভেতরে অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে তিন ফুট দূরত্ব মানতে হবে। আগে থেকেই গোল গোল চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে। যাতে সবার মানার ক্ষেত্রে সহজ হয়। তিনি বলেন, প্রত্যেক কারখানায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হওয়া দরকার। কারণ, শ্রমিকরা সাধারণত অপুষ্টিতে ভোগেন। এ কারণে কারখানার পক্ষ থেকে শ্রমিকদেরকে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা উচিত। এছাড়া শ্রমিকরা বাসায় কীভাবে থাকবেন, অফিসে কীভাবে কাজ করবেন তার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।
জানা গেছে, হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যেমন, মণ্ডল গ্রুপ, স্কয়ার ও এনার্জি এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের কারখানায় সীমিত আকারে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা আছে। এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমার জানা মতে, স্কয়ার ও এনার্জি এই দুটি ছাড়া আর কোনও গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে এনার্জির কারখানায় কাজ করে ১৮ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক। অথচ থাকার ব্যবস্থা আছে মাত্র এক হাজার শ্রমিকের। স্কয়ারেরও সব শ্রমিকের থাকার ব্যবস্থা নেই।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করা মালিকদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আর যদি শ্রমিকদের থাকার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়, তাহলে কারখানা খোলার বিষয়টিও আর এগুবে না, বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে নতুন করে মেশিন স্থাপন করলে অনেক শ্রমিক চাকরি হারাবেন। গ্যাপ দিয়ে দিয়ে নতুন করে মেশিন স্থাপন করার ফলে ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে অন্তত ১৬ লাখ শ্রমিককে ছাঁটাই করতে হবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আগে যে ফ্লোরে দেড়শ' শ্রমিক কাজ করতো। নতুন সেটআপের পর সেখানে ১০০ শ্রমিকের কাজের সুযোগ হবে। এতে প্রতি দেড়শ জনের মধ্যে অন্তত ৫০ জন শ্রমিকের চাকরি চলে যাবে। আর উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে এমনিতেই অনেকের চাকরি থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কারখানার শ্রমিকরা জানিয়েছেন, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ছাড়া তারা স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মানতে পারেন না। কারণ, তাদের দেওয়া হয়, সাধারণ মানের মাস্ক। আর মেশিনগুলো স্থাপন করা দেড় এক থেকে দেড় ফিট দূরত্বে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর শীর্ষ এক নেতার কারখানায় চাকরি করা একজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া আর সাধারণ মানের মাস্ক ছাড়া শ্রমিকদের আর কিছুই দেওয়া হয় না। কাজের সময় শ্রমিকদের বসতে হয়, এক থেকে দেড় ফিটের মধ্যে। কখনও কখনও এক মেশিন চালাতে দু'জন অপারেটর লাগে। তখন শ্রমিকদের মধ্যে দূরত্ব আরও কমে যায়।
তবে বিজিএমইএর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেভাবে কারখানাগুলোতে মেশিন বসানো (লে আউট করা) আছে, তাতে দুই জন শ্রমিকের মধ্যে দেড় ফিট দূরত্ব থাকে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী, দু'জন মানুষের দূরত্ব থাকতে হবে ৩ থেকে ৬ ফিট। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোনোভাবেই কারখানা খোলা রাখা যাবে না। কারণ, এখন এক লাইনে ১০টা মেশিন থাকলে সেখান থেকে ৪ থেকে ৫টা মেশিন সরিয়ে ফেলতে হবে। অর্থাৎ যে ফ্লোরে ৫০০ জন শ্রমিক কাজ করতো এখন সেই ফ্লোরে ২৫০ জনকে দিয়ে কাজ করাতে হবে। অর্থাৎ অর্ধেক শ্রমিককে চাকরি থেকে ছাঁটাই করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, অর্ধেক শ্রমিক কমানোর পরও আরও অন্তত ৫/৬টি কারণে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে গেলে গার্মেন্টস মালিকদের খরচ বেড়ে যাবে। কারণ, প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতিদিন নতুন নতুন হ্যান্ড গ্লাভস দিতে হবে, পিপিই দিতে হবে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিতে হবে। মানসম্মত মাস্ক দিতে হতে। নিজস্ব গাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। শ্রমিকের পরিবার যাতে ঘরের বাইরে বের না হয়, সে জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সাবেক সভাপতি ড. রশীদ ই মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্যবিধি যদি মানতে না পারেন, তাহলে কারখানা খোলা উচিত হবে না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেবলমাত্র স্বাস্থ্য বিধি মেনে যে কেউ চাইলে কারখানা খুলতে পারেন। এক্ষেত্রে শ্রমিকদেরকে কারখানার ভেতরে থাকতে দিতে হবে। শ্রমিকদের সবসময় ৩ ফুট দূরে দূরে থাকতে হবে। মানসম্মত মাস্ক পড়তে হবে। সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক বলেন, শ্রমিকদের ঝুঁকিতে ফেলে কোনও কারখানা খোলা হবে না। আমাদের প্রথম ইস্যু শ্রমিকের নিরাপত্তা। কাজেই শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়ে আমরা কারখানা খুলবো না।
তবে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ থাকলে অর্থনীতি শেষ হয়ে যাবে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়বে। এতে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা দেবে। এই মুহূর্তে কারখানা চালু করতে গেলে সব শ্রমিককে আসতে হবে এমন কোনও কথা নেই। সীমিত আকারে কারখানা চালু হলে কারখানার আশপাশে থাকা শ্রমিকরাই যথেষ্ট।
কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি ঠিকমতো মানা ও শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লাখ লাখ শ্রমিককে থাকার জন্য ঘর-বাড়ি বানিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে যেসব শ্রমিক কারখানায় কাজ করবে, তারা তুলনামূলক সেইফ থাকবে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, শ্রমিকরা যখন কাজে থাকে, তখন তারা একটি শৃঙ্খলার মধ্যে থাকে। আর যখন ছুটিতে থাকে, তখন বাইরে বেশি দেখা যায়। কারখানার মধ্যে শ্রমিকদের খুব কাছাকাছি থাকতে হয়। এতে করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেশিন দূরে দূরে সেট করলেও অসচেতন মানুষরা ঠিক সুযোগ পেলে কাছে চলে আসে। দেখা গেল, এখন কারখানায় দূরে দূরে বসিয়ে রাখলাম। কিন্তু বাসায় যাওয়ার সময় ঠিকই একসঙ্গে যাবে। অথবা দুপুরের খাওয়ার সময় বা ছুটি হলে ওরা একজন আরেকজনের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। ওদের ঠেকাবেন কী দিয়ে? আর এই সমস্যা শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেলায় এমনটি নয়, দেখা গেল বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু গলা ধরে হাঁটছে। আর আমরা সারা দেশের মানুষকে আটকিয়ে রাখতে পেরেছি কি?
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের সব অফিস আদালত বন্ধ রেখে নাগরিকদের ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। সব ধরনের যানবাহন চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ পোশাক কারখানাও। কিছু কারখানা চালু করার জন্য ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলের শ্রমিকদের নিরাপদে কর্মস্থলে নিয়ে আসতে পরিবহনের ব্যবস্থা করতে বিআরটিসির চেয়ারম্যানকে গত ১৫ এপ্রিল চিঠি লিখেছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক।