সাধারণ বাজেটে ব্যয়ের আকার বেশি এবং আয়ের অঙ্ক কম। ফলে যে ঘাটতির সৃষ্টি হয় সেটি দেশ-বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে পূরণ করা হয়। চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) বাজেট ঘাটতি হলো দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। সেটি পূরণে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ এক হাজার ২২৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও সুদ হিসাবে দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। একই সময়ে শ্রীলংকাকে আট হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং পাকিস্তানকে ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার হার জিডিপির তুলনায় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। পাশাপাশি শ্রীলংকায় এর হার ৪১ শতাংশ ও পাকিস্তানে ৩৯ শতাংশ।
সম্প্রতি গণভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনো ঝুঁকিসীমার অনেক নিচে রয়েছে। ভবিষ্যতে ঋণের বর্তমান এ অবস্থান ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের পর বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে চলতি বাজেটে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২০ হাজার ১৬ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। বছরের শুরুতে এ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ এক হাজার ২২৮ কোটি টাকা। কাটছাঁটের পর চূড়ান্ত বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ২১২ কোটি টাকা।
বৈদেশিক ঋণ কমানোয় দেশীয় ব্যাংক ঋণব্যবস্থার ওপর চাপ পড়েছে। ফলে বৈদেশিক ঋণের ঘাটতি মেটাতে দেশি ব্যাংকব্যবস্থা থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা বেশি ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ বিভাগ। বছরের শুরুতে এ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক থেকে সুদ নেওয়ার আরেকটি কারণ হলো-এখানে সুদ হার কম। অপর দিকে সঞ্চয়পত্রে বেশি। গত কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ঋণ নিয়েছে। সেই বর্ধিত ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ চলতি অর্থবছরে অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
বৈদেশিক ঋণের কাটছাঁটের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, পাইপ লাইনে এখনো অনেক বিদেশি ঋণ রয়েছে। কিন্তু ঋণছাড় করার যে শর্ত-পদ্ধতি সেগুলো নিষ্পত্তি করতে বিলম্ব অথবা নিষ্পত্তি না হওয়ায় হয়তো বিদেশি ঋণ পাওয়া যায়নি। কিংবা বিদেশিদের শর্ত পূরণ করে আমরা হয়তো ঋণ আনতে পারছি না। এ কারণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে সব সময় ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া ঠিক নয়। এতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
এ বছর ঋণ পরিশোধে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে অর্থ বিভাগ। কারণ সঞ্চয়পত্র খাত থেকে গত কয়েক বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। ফলে ওই ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ চলতি বাজেটে সৃষ্টি হয়েছে। সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দের অতিরিক্ত দুই হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হবে। বছরের শুরুতে সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ রাখা ছিল ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এখন ৮০ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা গুণতে হবে।
অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের আয় কমেছিল। ওই সময় সাধারণ মানুষকে সুবিধা দিতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নিয়েছে। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার অর্থ সাধারণ মানুষ বেশি কিনতে পেরেছে। ফলে গত কয়েক বছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রিও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। লক্ষ্যমাত্রাও অতিক্রম করেছে।
জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। ওই বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। একইভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ১৮ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। বড় অঙ্কের বর্ধিত সুদ পরিশোধের কারণে এ বছর হিমশিম খাচ্ছে অর্থ বিভাগ।