শেষ হাসিটা আর হাসা হলো না পাকিস্তানের। ১৩৭ রানের মাঝারি পুঁঁজি নিয়ে জয়ের মুখ দেখলো না বাবর-রেজওয়ানরা। পাকিস্তানকে উড়িয়ে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ট্রফি বুঝে নিল ইংলিশরা!
রোববার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালটা এমন একপেশে হবে কে জানতো? প্রতিশোধটা ইংলিশরা এমন করেই নিয়েছে যে ম্যাচে পাত্তাই পায়নি পাকিস্তান। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের গ্যালারির ৮০ হাজার ৪৬২জন দর্শক সামনে রেখে দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ট্রফি জিতল ইংল্যান্ড।
দিন-রাতের ম্যাচে বৃষ্টির শঙ্কা উড়িয়ে টস ভাগ্যটা জস বাটলারের পক্ষেই ছিল। ইংল্যান্ড অধিনায়ক আবহাওয়া আর এমসিজির উইকেটের কথা ভেবে শুরুতে বল তুলে দেন নিজ বোলারদের হাতে। তার সিদ্ধান্তটা যৌক্তিক হতে সময় লাগেনি। ২০ ওভারে পাকিস্তান ৮ উইকেট হারিয়ে তুলে মাত্র ১৩৭ রান। জবাবে নেমে পুরো টুর্নামেন্টে ফ্লপ বেন স্টোকস দেখান যোগ্যতার পরিধিটা। তার ব্যাটেই ইংল্যান্ড ফাইনালটা নিজেদের করে নেয়। ১৯ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড বনে যায় বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন!
পাকিস্তানের পেস আক্রমণকেই ভয় পেয়েছিল ইংল্যান্ড। সেই জুজুতে শুরুতে চাপে পড়েছিল তারা। এমনিতে লো স্কোরিং ম্যাচ অনেক সময়ই উপভোগ্য হয়। তেমন কিছুরই ইঙ্গিত ছিল শুরুতে। প্রথম ওভারেই ভাঙে ইংল্যান্ডের উদ্বোধনী জুটি। অ্যালেক্স হেলসকে বোল্ড করেন শাহিন শাহ আফ্রিদি। তার লেগ স্টাম্পে পড়ে সোজা আসা বলে হেলস ব্যাট চালিয়ে খেলতে পারেন নি। প্যাডে লেগে বল আঘাত হানে স্টাম্পে। ২ বলে ১ রানে আউট হেলস।
তারপরই হারিস রউফ ম্যাচটা জমিয়ে তুলেন ফিল সল্টকে ফিরিয়ে। পুল করতে গিয়ে মিস টাইমিং। সল্ট অনায়াস ক্যাচ তুলে দেন ইফতিখার আহমেদের হাতে। তিনি ফেরেন ৯ বলে ১০ রানে। তারপর অধিনায়ক জস বাটলারকে ফিরিয়ে ম্যাচটা জমিয়ে তুলেন হারিস রউফ। তার লাফিয়ে বলে ডিফেন্স করতে গিয়ে লাইন মিস করেন বাটলার। বলে সুইং থাকায় ব্যাটের বাইরের কানা স্পর্শ করে চলে যায় মোহাম্মদ রিজওয়ানের গ্লাভসে। ফেরার আগে ১৭ বলে ২৬ রান তুলেন বাটলার। আর পাওয়ার প্লের প্রথম ৬ ওভারে ইংল্যান্ড ৩ উইকেট হারিয়ে ৪৯!
তারপর বেন স্টোকস আর মঈন আলির ব্যাটে হাসিমুখ ইংল্যান্ডের। পরিস্থিতি বুঝে লড়ে গেছেন দু'জন। জানা ছিল আস্কিং রান বেশি নয়। টিকে থাকলেই চলবে। তাছাড়া পাওয়ার প্লে থেকেও ভাল রান পেয়েছিল দল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্টোকস খেলেন ঠান্ডা মাথায়। তার ব্যাটে ৪৯ বলে ৫৫ রান। মঈন তুলেন ১৩ বলে ১৯ রান!
এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা মোটেও ভাল হয়নি পাকিস্তানের। শুরুতেই রানআউটে ফিরতে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। ক্রিস জর্ডান মিস করায় প্রাণ পেলেও সেটি কাজে লাগাতে পারেন নি পাকিস্তানের এই ওপেনার। রিজওয়ানের উইকেট উড়িয়ে ইংল্যান্ডকে প্রথম সাফল্যটা এনে দেন স্যাম কারান।
এই পেনারের অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে পিচ করা বলে ব্যাট চালিয়ে ভুল করেন রিজওয়ান। ব্যস, ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে আঘাত হানে লেগ স্টাম্পে। ফেরার আগে ১৪ বলে ১৫ রান তুলেন রিজওয়ান। তার বিদায়ের সময় দল মহা বিপাকে। ৫ওভার শেষে পাকিস্তানের রান ১ উইকেটে ২৯ থাকলে তো আর টি-টোয়েন্টিতে স্বস্তি পাওয়া যায় না। তারপর প্রথম ৬ ওভার শেষে পাওয়া প্লে’তে ৩৯ রান।
তারপর মোহাম্মদ হারিসও যেতে পারেন নি বেশিদূর। আক্রমণে এসেই তাকে ফেরান আদিল রশিদ। তখন খেলা চলছিল অষ্টম ওভারের। বল হাতে নিয়েই বোকা বানান হারিসকে। তার প্রলুব্দ তরা বলে উইকেট ছেড়ে মারতে গিয়ে সর্বনাশ হয়ে যায় তার। টাইমিং ভুলে লং-অনে বেন স্টোকসের হাতে বল দিয়ে সাজঘরের পথ ধরেন এই পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান। তার আগে করেন ১২ বলে ৮।
তারপর অবশ্য কিছুটা লড়াইয়ে ফেরার চেষ্টা করেছে পাকিস্তান। অধিনায়ক বাবর আজমের সঙ্গে শান মাসুদের জুটিটা জমেই যাচ্ছিল। তবে রান তোলার গতিটা কখনোই সন্তুষ্ট হওয়ার মতো ছিল না। মেলবোর্নের উইকেট প্রথম ১০ ওভার শেষে পাকিস্তান তুলে ২ উইকেটে ৬৮।
তারপর ফের পথ হারায় ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা। সেই আদিল রশিদে সর্বনাশ তাদের। আদিলের গুগলিতে বোকা বনে ক্যাচ তুলে দেন বাবর। ১২তম ওভারের প্রথম বলেই গুগলি করেন আদিল। তার ডেলিভারি এতোটাই বাঁক নিচ্ছিল যে ব্যাটে ঠিকঠাক খেলতে পারেন নি বাবর। ক্যাচ উঠলে হাতে জমাতে ভুল করলেন না আদিল। পাকিস্তান অধিনায়ক দলকে চাপে ফেলে ফিরেন ২৮ বলে ৩২ রানে।
টানা দুই ওভারে উইকেট হারিয়ে পথটাও হারিয়ে ফেলে পাকিস্তান। আদিলের পর বল হাতে ম্যাজিক দেখান বেন স্টোকস। তিনি তুলে নেন ইফতিখার আহমেদের উইকেট। স্টোকসের দ্রুতগতির লাফিয়ে উঠা বল খেলতে পারেন নি ইফতিখার। বল তার গ্লাভস ছুঁয়ে চলে যায় অধিনায়ক জস বাটলারের গ্লাভসে। ৬ বল খেলে কোন রান না করেই ফেরেন তিনি!
এরপর শাদাব খান-শান মাসুদ জুটি গড়ে স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন পাকিস্তানকে। গ্যালারিতে রাজত্ব করা পাকিস্তানি দর্শকদের কিছুটা সময়ের জন্য হলেও স্বস্তি দেন দু'জন। কিন্তু বড় জুটি গড়া হয়নি। দ্বিতীয় স্পেলে এসে স্যাম কারান ভাঙেন এই জুটি। তার বলে হাওয়ায় ভাসাতে গিয়ে সীমানা পার করতে পারলেন না। মিড উইকেটে লিয়াম লিভিংস্টোনের হাতে ক্যাচ তুলে দেন মাসুদ। তার আগে করেন
২ চার ও ১ ছক্কায় ২৮ বলে ৩৮। ভাঙে ৩৬ রানের জুটি।
তারপরও শাদাবও দ্রুত মাসুদের সঙ্গী হয়ে হতাশায় ভাসান মেলবোর্নের গ্যালারিতে হাজির পাকিস্তানিদের। ক্রিস জর্ডানের বলে পুল করতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে শাদাব। অবশ্য বোর্ডে রান উঠছিল না, চাপ তো থাকবেই। মিড অফে ক্রিস ওকসের হাতে ক্যাচ তুলে দেওয়ার আগে তিনি করেন ১৪ বলে ২০। তারপর কারান তুলে নেন মোহাম্মদ নাওয়াজের উইকেটও। ৭ বলে ৫ রান ফেরেন তিনি!
কারানের আগুনঝরা বোলিংয়ে পথ হারায় পাকিস্তান। তারপর আর ফেরা হয়নি। কারনি ৪ ওভারে মাত্র ১২ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট। রশিদ দুই উইকেট নিয়েছেন ২২ রানে। ২৭ রানে সমান উইকেট ক্রিস জর্ডানের!
শোককে শক্তিতে পরিনত করল ইংল্যান্ড। একদিন আগেই চলে গেছেন ইংল্যান্ড ক্রিকেটের গডফাদার খ্যাত ডেভিড ইংলিশ। তার প্রয়ানে শোকাত ইংলিশ ক্রিকেটাররা বাহুতে কালো ব্যান্ড নিয়ে নামে মাঠে। এমন শোকের দিনটাকেই অনন্য এক অর্জনের ক্ষণ বানিয়ে ফেলল জস বাটলারের দল। কী আশ্চর্য, গত কয়েক দিন ধরে মেঘ-বৃষ্টির-রোদ্দুরের যে গল্প চলছিল, তা ম্যাজিকের মতো উধাও!
নির্বিঘ্নে খেলা হলো আর সেই খেলায় পাকিস্তানকে নিয়ে খেলল ইংল্যান্ড। প্রতিশোধ হয়তো এভাবেই নিতে হয়। ৯২ আর ফিরে আসল না, বাবর আজমও হতে পারলেন না ইমরান খান! সেই মেলবোর্নেই ১৯৯২ এর 'প্রতিশোধ' নিল ইংল্যান্ড।
অর্থসংবাদ/কেএ