তাদের এ অর্জনের মধ্য দিয়ে ট্রিলিয়ন (এক লাখ কোটি) ডলারের মাইলফলক অর্জনের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশও।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং ফার্ম বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের (বিসিজি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিপর্যয়ের পরও কিভাবে দেশটির অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার ওপর আলোকপাত করে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে।
শুক্রবার রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘দ্য ট্রিলিয়ন-ডলার প্রাইজ-লোকাল চ্যাম্পিয়নস লিডিং দ্য ওয়ে’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলক। মূল বক্তা ছিলেন এইচএসবিসি বাংলাদেশের করপোরেট কমার্শিয়াল ব্যাংকিংয়ের কান্ট্রি হেড রিয়াজ এ চৌধুরী। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে ছিলেন বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের গ্লোবাল চেয়ার ইমেরিটাস ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর হ্যান্স-পল বার্কনার, বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের সিনিয়র পার্টনার ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর জারিফ মুনির, প্রতিষ্ঠানটির পার্টনার ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর শৈবাল চক্রবর্তী, বোস্টন কলসাল্টিং গ্রুপের পার্টনার তৌসিফ ইশতিয়াক প্রমুখ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাবসায়িক কমিউনিটি, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্রুত সম্প্রসারণে প্রবৃদ্ধিশীল ভোক্তা বাজার, সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি ফ্রিল্যান্সার নিয়ে ক্রমবর্ধমান গিগ ইকোনমি, সঙ্গে ডিজিটাল রূপান্তর এবং সরকারের বহুমুখী প্রচেষ্টা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে চলেছে।
ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এ প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে অপ্টিমিস্টিক আউটলুক (দৃঢ় আশাবাদ), গিগ ইকোনমি (ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল খণ্ডকালীন কাজ), ভোগ্য পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি, তরুণ ও ক্রমবর্ধমান কর্মশক্তি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা (হাই ইকোনমিক রেজিলিয়ান্স), ডিজিটাল মাধ্যমের বহুল ব্যবহার, সরকারি উদ্যোগ এবং একটি বৃহৎ, সুসংগঠিত বেসরকারি খাতসহ বিভিন্ন বিষয় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বাংলাদেশের উদীয়মান চ্যাম্পিয়নরা নিজেদের বিশ্বের দরবারে সেরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ও দেশকে নেতৃত্ব দিতে নিত্যনতুন কৌশল নিচ্ছে এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে। এভাবেই বাংলাদেশ ২০৪০ সাল নাগাদ এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উদীয়মান কম্পানিগুলো উদ্ভাবনী, দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঠামোগত সুবিধা তৈরি করেছে এবং বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণেও প্রস্তুত। এ চ্যাম্পিয়নের সাফল্য অন্যান্য দেশের অনুকরণীয় কম্পানিগুলোর উদ্যোগেরই প্রতিধ্বনি। নিজস্ব দক্ষতা, সফলতা ও গুণগত মান অর্জনে তারা যেন দ্বিগুণ প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এই চ্যাম্পিয়নদের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক পুঁজি বাড়ানো, বৈশ্বিক জোট গঠন এবং সরবরাহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈচিত্র্যময় ও পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রবেশ করা। বেসরকারি খাত উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে এবং সুগঠিত কৌশলগত কর্মসূচির মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল সুবিধাকে কাজে লাগাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই চ্যাম্পিয়নরা বাংলাদেশের ট্রিলিয়ন ডলারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে শক্তিশালী অবদান রাখবে। ’
প্রতিবেদনটি বিসিজির বিশ্লেষণ এবং বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কম্পানিগুলোর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, যাদের বার্ষিক আয় ৩০০ মিলিয়ন থেকে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উদীয়মান এ কম্পানিগুলো বছরে গড়ে ১৬ শতাংশ করে রিটার্ন দিয়েছে তাদের শেয়ারহোল্ডারদের, যা বৈশ্বিক হিসাবে চমকপ্রদ অর্জন। যেমন এটি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল ১২০০ কম্পানিগুলোর ১৫ শতাংশ, এশিয়া ৫০ ইনডেক্সের ১৪ শতাংশ এবং এমএসসিআই এমার্জিং মার্কেটের ১০ শতাংশের বেশি।
বিসিজি প্রতিবেদনে কম্পানিগুলোর মধ্যে দৃঢ় আশাবাদ পেয়েছে এবং এদের ৫৭ শতাংশ বিশ্বাস করে পরবর্তী প্রজন্ম আরো ভালো জীবনযাপনের সুযোগ পাবে। বাংলাদেশের একটি উদীয়মান তরুণ শ্রমশক্তি রয়েছে। যাদের গড় বয়স ২৮ বছর। এ দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৬৮.৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশে ৮৩ শতাংশ কম্পানির সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভিশন রয়েছে এবং ৩৮ শতাংশ আরো ভালো গ্রাহক ফলাফল অর্জনে মনোনিবেশ করেছে। প্রায় ৭৮ শতাংশ কম্পানি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে তারা প্রতিনিয়ত রূপান্তরের একটি সংস্কৃতি তৈরি করতে সক্ষম হবে এবং ৬১ শতাংশ আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণে কৌশল গ্রহণ করেছে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড তৈরি করার জন্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভোক্তা বাজার বিশ্বের নবম বৃহৎ হওয়ার পথে রয়েছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণির দ্রুত বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে। এই শ্রেণিটি ২০২০ সালের ১৯ মিলিয়ন থেকে ২০২৫ সাল নাগাদ হবে ৩৪ মিলিয়ন। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গড়ে বার্ষিক ৬.৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডকে ছাড়িয়েছে। এ দেশের প্রবৃদ্ধির হার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর দ্বিগুণ এবং বৈশ্বিক গড় ২.৯ শতাংশের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি।
বিসিজির বৈশ্বিক চেয়ার ইমেরিটাস হ্যানস-পল বার্কনার বলেন, ‘চীন ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ায় দুটি ডায়নামিক দেশ রয়েছে। আমি বলতে চাইছি ভারত ও বাংলাদেশ শক্তিশালী গতিতে রয়েছে। ’
বৈশ্বিক টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক সরবরাহ শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। বিসিজি মনে করে, এই খাতের দেশীয় কম্পানিগুলো বিশ্বজুড়েও তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করবে। এ ছাড়া ডিজিটাল খাতে সরকারি ব্যয় গত এক দশকে তিন গুণ বেড়েছে। সরকারের ২০৪১ ভিশন ও স্মার্ট জাতীয় পরিকল্পনা এই খাতের প্রবৃদ্ধিকে জোরালো করছে। টেলিকম খাতে বিশ্বের নবম বৃহৎ মোবাইল মার্কেটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এনজিও খাতও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য চালকের ভূমিকা রাখছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংক বিশাল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তা জালে নিয়ে আসছে। স্টার্টআপ শিল্প এরই মধ্যে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের ওপর তহবিল গড়ে তুলেছে। সরকারও এ খাতকে এগিয়ে নিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। অন্যান্য খাতের মধ্যেও অনেক কম্পানি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভূমিকা রাখছে। যেমন—প্রাণ-আরএফএল আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ফ্র্যাঞ্চাইজি গড়ে তুলছে। ওষুধ কম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে বাজার বিস্তৃত করছে। প্রতিবেদনে ওয়ালটন, স্কয়ার, বেক্সিমকো, পিএইচপি, সামিট গ্রুপ, বিকাশ, শপ আপ, পাঠাও, ব্র্যাক ব্যাংক, রেনেটা, মেঘনা ও কনফিডেন্স গ্রুপের সাফল্যের কথা উঠে এসেছে। বিসিজি মনে করছে, বর্তমান বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। তবে বাংলাদেশ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সফলতার সঙ্গেই এ দেশ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে।
অনুষ্ঠানে জুনাইদ আহেমদ পলক বলেন, ‘আমরা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে বিশ্বাসী। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ অর্জনকে লক্ষ্য রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, ২০২৫ সালের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে অন্তত পাঁচটি ইউনিকর্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গড়ে উঠবে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনেক আগেই ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। এ বিষয়টি এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমি বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপকে এ ধরনের সমীক্ষা পরিচালনার জন্য ধন্যবাদ জানাই, যেখানে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার চিত্র উঠে এসেছে। ’
বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের গ্লোবাল চেয়ার ইমেরিটাস হ্যান্স-পল বার্কনার বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন অন্যান্য উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য রোল মডেল। এই দেশটি এরই মধ্যে অনেক কিছু অর্জন করেছে। বিশেষ করে দেশের বেসরকারি খাতের অপরিসীম অবদানের কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর রূপান্তর এবং দেশের বেসরকারি খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান এই গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। লক্ষ্য অর্জন করতে এবং দেশের
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত রাখতে স্থানীয় বেসরকারি খাতের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে রূপরেখা আমাদের সমীক্ষায় প্রকাশ করা হয়েছে। ’
এ বিষয়ে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের সিনিয়র পার্টনার ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর জারিফ মুনির বলেন, ‘এই প্রতিবেদন নিয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত। ৫-৭ বছর আগে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি দেশের প্রবৃদ্ধির পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাত থেকে উদীয়মান চ্যাম্পিয়নরা তৈরি হয়েছে, যাদের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে, পরিণত হবে ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমিতে। আমাদের উদীয়মান চ্যাম্পিয়নদের বৈশ্বিকভাবেও বিস্তৃতির লক্ষ্য রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে তাদের এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র হবে—সব সময় রূপান্তরে প্রাধান্য দেওয়া, সামাজিক প্রভাবসহ আরো অনেক বিষয়।