শেয়ারবাজারে অস্বস্তির বছর: ইতিবাচক সিদ্ধান্তেও পোক্ত হয়নি আস্থা

শেয়ারবাজারে অস্বস্তির বছর: ইতিবাচক সিদ্ধান্তেও পোক্ত হয়নি আস্থা

চলতি বছরের প্রথম কার্যদিবসে সূচকের বড় লাফ আশা জাগানিয়া বার্তা দিয়েছিল শেয়ারবাজারে। বছর শুরুর আট কর্মদিবসে প্রধান সূচক ৭ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়া যেন বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা পোক্তের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তবে সেই আস্থা বেশিদিন টেকেনি। এক্সপোজার লিমিট ইস্যুর সমাধান, অবণ্টিত লভ্যাংশ দিয়ে ফান্ড গঠন এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ফ্লোর প্রাইস জারির পরও অস্বস্তিতেই পার হচ্ছে শেয়ারবাজারের ২০২২ সাল।


ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম কার্যদিবসে (২ জানুয়ারি) এক্সচেঞ্জটির প্রধান সূচক ‘ডিএসই এক্স’ ৯৭ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। মাত্র আট কার্যদিবস পর ১১ জানুয়ারি ৭ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায় প্রধান মূল্যসূচক। পরের দিন সামান্য পতনে ৬ হাজার পয়েন্টের ঘরে নেমে এলেও একদিন পরই ৭ হাজার ১৭ পয়েন্টে স্থির হয় ‘ডিএসই এক্স’। ৩০ জানুয়ারি সূচকটি সাত হাজারের নিচে নেমে যায়। ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত হাজারের ঘরেই অবস্থান করে ‘ডিএসই এক্স’।


২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বৃদ্ধি পায় শেয়ার বিক্রির চাপ। একদিনেই বিনিয়োগকারীরা ২৮ কোটি ২৬ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেন। দরপতন হয় তিন শতাধিক কোম্পানির শেয়ারের। ফলে ২৪ ফেব্রুয়ারি একদিনেই ১০৯ দশমিক ২৩ পয়েন্ট হারায় ডিএসইর প্রধান সূচক। পরের কার্যদিবসে (২৭ ফেব্রুয়ারি) আরও বড় পতন হয় শেয়ারবাজারে। সেদিন ২৫ কোটি ৬৯ লাখ শেয়ার বিক্রি হয় ডিএসইতে। দরপতন হয় লেনদেনে অংশ নেওয়া ৯৬ শতাংশের বেশি কোম্পানির শেয়ারের । ‘ডিএসই এক্স’ হারায় ১৬৩ পয়েন্ট।


জানুয়ারিতে আশা জাগানো শেয়ারবাজার হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ে। ফেব্রুয়ারির শেষে শুরু হয় যুদ্ধ আতঙ্ক। বিনিয়োগকারীদের আতঙ্ককে পুঁজি করে শেয়ারবাজারে ছড়ানো হয় বিভিন্ন ধরণের গুজব। ফলে ২৪ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি দুই কার্যদিবসেই ডিএসইর প্রধান সূচক হারায় ২৭২ দশমিক ৫৩ পয়েন্ট। মার্চ মাসের ২২ কার্যদিবসের মধ্যে পতন হয় ১০ দিন। এর মধ্যে ৭ মার্চ একদিনেই ডিএসইর প্রধান সূচক হারায় ‘১৮২ দশমিক ১২ পয়েন্ট। সেদিন লেনদেনে অংশ নেওয়া ৩৭৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৬৪ কোম্পানির শেয়ারদরেরই পতন হয়। এপ্রিলের ১৯ কার্যদিবসের মধ্যে ১০ দিন, মে মাসে ১৮ কার্যদিবসের মধ্যে ১১ দিন, জুনে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে ১০ দিনই শেয়ারবাজারে পতন হয়।


জুলাই মাসে শেয়ারবাজারে অনাস্থা চরম আকার ধারণ করে করে। জুলাইয়ের ১৯ কার্যদিবসের মধ্যে ১৪ কার্যদিবসই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকের পতন হয়। এর মধ্যে ১২ জুলাই থেকে টানা ৯ কার্যদিবস টানা পতন হয় ডিএসইতে। প্রতিদিন দরপতন হতে থাকে শতাধিক কোম্পানির। ২৮ জুলাই ৫ হাজারের ঘরে আসে ‘ডিএসই এক্স’। এমন অবস্থায় টানা দরপতন ঠেকাতে ২৮ জুলাই শেয়ারবাজারে পুনরায় ফ্লোর প্রাইস জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সব সিকিউরিটিজের পাঁচ দিনের ক্লোজিং প্রাইসের গড় মূল্যকে ফ্লোর প্রাইস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।


বিএসইসির ২৮ জুলাইয়ের আদেশে বলা হয়, ৩১ জুলাই থেকে নির্ধারিত ফ্লোর প্রাইসের উপরে সিকিউরিটিজের দর স্বাভাবিক হারে উঠানামা করতে পারবে। তবে ফ্লোর প্রাইসের নিচে নামতে পারবে না। কোন কোম্পানির বোনাস শেয়ার বা রাইট শেয়ারের কারণে ফ্লোর প্রাইসে থাকা সিকিউরিটিজের দর সমন্বয় করা হবে। নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের ক্ষেত্রে প্রথম দিনের লেনদেনের ক্লোজিং দর হবে ওই শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস। এছাড়াও কোনো কোম্পানি বোনাস লভ্যাংশ দিলে রেকর্ড তারিখের আগের দিনের শেয়ারের মূল্যের সাথে সেটি সমন্বয় করে নতুন ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হবে।


শেয়ারে সর্বনিম্ন দর নির্ধারণের পর কিছুদিন শেয়ারবাজারে স্বস্তি ছিল। ফ্লোর প্রাইস জারির পরের কার্যদিবসেই (৩১ জুলাই) সূচকের বড় উল্লম্ফন হয়। লেনদেনে অংশ নেওয়া ৩৮২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৬২টির শেয়ারদরই বৃদ্ধি পায়। সূচকে যোগ হয় ১৫৩ দশমিক ৪৫ পয়েন্ট। আর ফ্লোর প্রাইস জারির প্রথম সপ্তাহেই বাজার মূলধন বৃদ্ধি পায় ২১ হাজার কোটি টাকা। আগস্টের ২০ কার্যদিবসের মধ্যে ১৫দিনই উত্থানে ছিল শেয়ারবাজার। এর মধ্যে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণেই বাজারে পতন হয়। বিএসইসি থেকে গুজবকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে বলা হয় ‘বহাল থাকছে ফ্লোর প্রাইস’।


সেপ্টেম্বরে সূচকের লাফ দেওয়ার প্রবণতা কমতে থাকে। মাসজুড়ে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে ১০ দিন পতন হয় ডিএসইতে। বেশিরভাগ কোম্পানির দর অপরিবর্তিত থাকায় নতুন করে অস্বস্তি শুরু হয় শেয়ারবাজারে। অক্টোবরে ১১ ও নভেম্বরে ১০ কার্যদিবস নিম্নমুখী থাকে সূচক। ডিসেম্বরে এখন পর্যন্ত ৮ কার্যদিবস পতন হয়েছে ডিএসইতে। এর মধ্যে গত পাঁচ দিন টানা পতনে বড় অস্বস্তি তৈরী হয়েছে বাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।


চলতি বছরে মোট ১০৪ দিন হাজার কোটি টাকার গন্ডি পেরিয়েছে লেনদেন। এর মধ্যে লেনদেন ২ হাজার কোটি টাকা পেরিয়েছে মাত্র ৫ দিন। বছরের মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। সেদিন ডিএসইতে ২ হাজার ৮৩২ কোটি টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছিল। বাকি কার্যদিবসে হাজার কোটি টাকার ছুঁতে পারেনি লেনদেন। গত ২৮ কার্যদিবস লেনদেনে টানা অস্বস্তি চলছেই। এর মধ্যে ১৮ কার্যদিবই লেনদেন নেমে এসেছে ৫০০ কোটি টাকার নিচে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারল্য সংকট না থাকলেও ফ্লোর প্রাইসের কারণে বাজারে লেনদেনের গতি কমেছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছেন না।


পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ অর্থসংবাদকে বলেন, জুলাই পর্যন্ত শেয়ারবাজার ভালোই ছিল। ফ্লোর প্রাইস জারির পর বাজারের খারাপ অবস্থা শুরু হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না। ফলে তাঁরা নতুন করে শেয়ার কিনতেও পারছে না। এখন অনেক বিনিয়োগকারীরা ব্রোকারেজ হাউজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।


তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে শেয়ারের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে প্রায় সব দেশের অর্থনীতি খারাপ হচ্ছে। অর্থনীতি খারাপ থাকলে সেটার প্রভাব শেয়ারবাজারেও থাকবে। তাই বলে শেয়ারের দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে কেন? বাজারে অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে সূচক বাড়বে। কিন্তু অর্থপ্রবাহ কমেছে, কৃত্রিমভাবে সূচক বাড়ানো হচ্ছে।


ফ্লোর প্রাইসের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছে না- এমনটি মানতে নারাজ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সংস্থাটির মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর বছর সমাপ্ত হয় ডিসেম্বরে। ইয়ার ইন্ডিংয়ের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখন বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত খুব কম নিচ্ছে। আশা করি জানুয়ারি থেকেই তাঁরা (প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী) নতুন করে আবার বিনিয়োগে আসবে। তখন আমরা বাজারে লেনদেন ও সূচকের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব দেখতে পারবো।

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

ফু-ওয়াং সিরামিকের লভ্যাংশ অনুমোদন
এক বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা
ডিএসইতে মোবাইল গ্রাহক-লেনদেন দুটোই কমেছে
বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন পেয়েছে ৯ কোম্পানি
পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ আজ
বছরের ব্যবধানে পুঁজিবাজারে লেনদেন বেড়েছে ৪০ শতাংশ
রবিবার পুঁজিবাজার বন্ধ থাকলেও চলবে দাপ্তরিক কার্যক্রম
লোকসানে ৮ খাতের বিনিয়োগকারীরা
সাপ্তাহিক রিটার্নে মুনাফায় ১০ খাতের বিনিয়োগকারীরা
খাতভিত্তিক লেনদেনের শীর্ষে প্রকৌশল খাত