ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ব্যক্তি ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হলে তিনি নিজ নামে নানা সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না। নতুন আইনে দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তির পাসপোর্ট জব্দকরণ বা বাতিল করা হবে। দাওয়াত দেয়া হবে না রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে। কোম্পানির পরিচালক কিংবা ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ, গাড়ি কেনায়ও অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। এছাড়া একাধিক ব্যাংক হিসাব পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিধি-নিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার।
বিদ্যমান দেউলিয়া আইন সংশোধন করে নতুন এসব ধারা যুক্ত করতে যাচ্ছে সরকার। ‘দেউলিয়া বিষয়ক আইন, ১৯৯৭’ এর সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত ৯ আগস্ট আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে স্টেকহোল্ডারদের মতামত চেয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তার খসড়াতেও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাসহ বাড়ি, গাড়ি কেনা, কোম্পানির পরিচালক হওয়ার অযোগ্য ঘোষণার কথা বলা হয়েছে।
১৯৯৭ সালে দেশে দেউলিয়া বিষয়ক আইন হলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০০০ সালে এ আইনের অধীনে একটিমাত্র কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর এ আইনে আর কোনো বিচার হয়নি। দেউলিয়া আদালত স্থাপন না করা ও মামলা নিষ্পত্তিতে কোনো সময়সীমা নির্ধারণ না থাকার পাশাপাশি আইনি দুর্বলতার কারণে এটি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিদ্যমান আইন সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায় আইন সংশোধনের উদ্যোগকে আমলে নাও নিতে পারেন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি ব্যক্তিরা বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ঋণ খেলাপিদের জন্য আতঙ্কের আরও একটি কারণ হতে পারে একই সঙ্গে অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ সংশোধনের উদ্যোগ।
ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে পাওনাদারদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে দেউলিয়া আদালতে শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ অর্থঋণ আদালত আইনে রাখতে যাচ্ছে সরকার। অর্থঋণ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ৯০ দিনের মধ্যে দেনাদারকে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। যদি কোনো দেনাদার তা না করে, তখন ওই রায় দেউলিয়া আদালতে পাঠাবেন অর্থঋণ আদালত। তার প্রেক্ষিতে দেউলিয়া আদালত দেনাদারকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারবে। এজন্য অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ সংশোধনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা দেউলিয়া আইনকে কঠোর করার উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, প্রস্তাবিত ও নতুন সংযোজিত ধারাগুলো কার্যকর করা গেলে ঋণখেলাপি কমবে।এ আইনে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো আইনে জায়গা পেলে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি কমে আসবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তির দখলে বা হেফাজতে থাকা ব্যাংক ঋণের বিপরীতে থাকা বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করতে না পারলে ঋণদাতা ব্যাংকের পক্ষে অর্থ আদায় করা সম্ভব হত না। বিদ্যমান আইনে বলা হয়েছে, নিলামে বিক্রি করতে না পারলে ওই সম্পত্তির মালিকানা ব্যাংকের হাতে চলে যাবে। এজন্য নতুন একটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘দেনাদার কিংবা দখলদারদের দখলে বা হেফাজতে রক্ষিত ব্যাংক ঋণের বিপরীতে বন্ধকীকৃত সম্পত্তি ১ বছরের মধ্যে বিক্রয় করিতে ব্যর্থ হন, তাহা হইলে ঐ বন্ধকীকৃত সম্পত্তির মালিকানা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোম্পানি বা ব্যাংক কোম্পানিসমূহের উপর ন্যাস্ত করিয়া একটি সার্টিফিকেট ইস্যু করিবে যাহা সম্পত্তিটির দখল, মালিকানা ও বিক্রয়ের ক্ষমতা প্রাপ্ত হইবে/সাবরেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করিবার জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হইবে’।
খসড়া আইনে মামলা নিষ্পত্তির জন্য ১২০ দিন সময় বেধে দিয়ে বলা হয়েছে, মামলা সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পন্ন করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে না পারলে উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করে আদালত আরও সর্বোচ্চ ৩০ দিন বাড়াতে পারবে।
খসড়া সংশোধনী প্রস্তাবে আদালত সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আইনে কোন জেলাজজ তার জজশিপে কর্মরত যেকোনো অতিরিক্ত জেলা জজকে বিচার করার ক্ষমতা দিতে পারতেন। খসড়ায় জেলাজজ তার জজশিপে কর্মরত যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার এক বা একাধিক জজকে অর্থঋণ আদালতের কার্যক্রমের পাশাপাশি এই আইনের আওতায় দেউলিয়া আদালত পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারবেন।
আপিলে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা রয়েছে সংশোধনী প্রস্তাবে। বিদ্যমান আইনে আদালতে নির্ধারিত দেনার ১০ শতাংশ নগদ পরিশোধ সাপেক্ষে ১০ দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আপিল করতে হলে নির্ধারিত দেনার ২৫ শতাংশ ১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।
বিদ্যমান আইনে গ্রেফতার বা কারাবন্দি থাকা দেনাদার ব্যক্তিকে আদালত নিজ থেকে কিছু শর্ত দিয়ে মুক্তি দিতে পারবেন। নতুন আইনে বলা হয়েছে, অর্থ পরিশোধ সংক্রান্ত ডিক্রির টাকার কমপক্ষে ২৫ শতাংশ নগদ জমা সাপেক্ষে অবশিষ্ট অংশ এককালীন কিংবা আদালত কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কিস্তিতে পরিশোধের জন্য দেনাদারের কাছে হইতে হলফনামা যুক্ত অঙ্গীকারনামা নিয়ে আদালত দেনাদারকে মুক্ত করার আদেশ দিতে পারবেন।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক ও আর্থিকখাতে খেলাপি ঋণ কমাতে দেউলিয়া আইন সংশোধনের ঘোষণা দেন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানও দেউলিয়া আইন সংশোধন করতে অর্থমন্ত্রীকে লিখিত সুপারিশ করেন। তার প্রেক্ষিতেই এ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।