এছাড়া আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের (ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র খাত) গড় অন্তর্নিহিত সুদ হার ৭ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রাক্কলন করেছে। আর মধ্যমেয়াদে সার্বিক সুদ হার ৬ শতাংশের নিচে আনাও পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমান সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদ হার ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে এসব উদ্যোগের ফলে এ খাতে মধ্যবিত্তদের ক্রয়সীমা কমবে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সঞ্চয়পত্রকে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হিসাবে নিয়েছে। কিন্তু আইএমএফ বলেছে, এটি সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদি দায়। কারণ সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে বড় অঙ্কের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রতিবছর। ফলে পর্যায়ক্রমে এ দায় কমাতে বলেছে সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কবে নাগাদ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে সেটি অনিশ্চিত। এর সঙ্গে অব্যাহত আছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এছাড়া সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের উৎস ব্যাংক থাকলেও সেখানে আমানতের সুদ হার অনেক কম। অনিরাপদ হয়ে উঠছে অস্থিতিশীল পুঁজিবাজারও। ফলে মধ্যবিত্তদের একমাত্র ভরসা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র। বৃহত্তম একটি জনগোষ্ঠী উপকৃত হচ্ছে এখানে বিনিয়োগ করে। সামাজিক সুরক্ষার আওতা হিসাবে এটি কাজ করছে। কিন্তু এখানে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনলে বড় একটি শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ বিষয়ে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার সীমা কমানো হলে বিক্রি কমবে। এতে মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য সমস্যা হবে। কারণ মধ্যবিত্ত মানুষগুলো এই সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দিয়ে অনেকে সংসার পরিচালনা করছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সমস্যা হচ্ছে একটি আর্থিক টুলস সঞ্চয়পত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা হিসাবে। এতে আর্থিক সিস্টেম নষ্ট হচ্ছে। আর সিস্টেম নষ্ট হলে আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি মনে করেন, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা সরকার ভিন্নভাবেও দিতে পারে। অবসরভোগীদের সুবিধা দিতে হলে সরকার পেনশনের অঙ্ক বাড়াতে পারে। তিনি আরও বলেন, সঞ্চয়পত্র বন্ড মার্কেটকে ধংস করছে। এ খাতে সুদ হার বেশি থাকায় বেসরকারি কোম্পানিগুলো সঞ্চয়পত্র থেকে অধিক সুদ দিয়ে বাজারে বন্ড ছাড়তে আগ্রহী হচ্ছে না। আর বন্ড মার্কেট উন্নতি না হলে আর্থিক খাতের উন্নয়ন হবে না। ভারত তাদের সঞ্চয়পত্রের জন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান করে দিয়েছে। এসব বিষয় আমাদেরও এখন ভাবতে হবে।
সঞ্চয়পত্র নিয়ে আইএমএফ’র রূপরেখা : চলতি অর্থবছর দেশের বাজেট ঘাটতি মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। আইএমএফ’র প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ ঘাটতি কমে দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এই ঘাটতি কমানোর পেছনে নিয়ামক হিসাবে ধরা হয়েছে কর খাতে আয় বৃদ্ধি। সংস্থাটি হিসাব কষে বলেছে, ২০২৩-২০২৬ পর্যন্ত এই তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত কর রাজস্ব বাড়াতে হবে ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই কর আদায় হলে ঘাটতি বাজেট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসবে। আর ঘাটতি কমে আসলে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নেওয়ার অঙ্কও কমবে। ওই সময় ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ ঋণের এক-চতুর্থাংশ নিতে হবে সঞ্চয়পত্র থেকে। অবশিষ্ট ঋণ নিতে হবে ব্যাংকিং খাত থেকে।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে দেশের বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে (৩ দশমিক ৩ শতাংশ হারে) ২ লাখ ৩ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণে ৭৪ শতাংশ ঋণ নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ খাত (ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র) থেকে। ফলে অভ্যন্তরীণ ঋণের অঙ্ক দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এর এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ৩৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে পারবে না সঞ্চয়পত্র থেকে।
যদিও চলতি অর্থবছরে সরকার ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। ফলে শর্ত পূরণ করতে গিয়ে আগামী ৩ অর্থবছরে খুব বেশি বাড়বে না সঞ্চয়পত্র বিক্রি।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে আইএমএফ। এরই মধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করেছে সংস্থাটি।