অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বক্তব্য রাখেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইখতেখারুজ্জামান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম প্রমুখ।
সভায় ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা, নতুন ভূমি আইন ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটালাইজেশন নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তোলেন। উত্তরাধিকার আইন নারীদের জন্য বৈষম্যমূলক ও নারীরা নানা কায়দায় পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয় বলে অভিযোগ জানান নারী প্রতিনিধিরা।
এ প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে নারীদের বঞ্চিত করা হয়। ভাইদের টেনডেনসি আছে বোনদের বঞ্চিত করে জমি নিয়ে নেওয়া। ইটস অ্যা ক্রাইম। এটা যদি কেউ বলে আমার বোন মৌখিকভাবে আমাকে দিয়েছে, তাও মাফ নাই। ওই অপরাধে তাকে জেলে ঢুকতে হবে, সাজা তাকে পেতে হবে। এটা ভূমি অপরাধ আইনে আসছে।’
রিসার্স ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের প্রতিনিধি সুরাইয়া বেগম বলেন, উত্তরাধিকার আইনে অনেক বৈষম্য আছে। তারপরও যতটুকু প্রাপ্য নারী সেটা পায় না। ভূমি মন্ত্রণালয় যখন ডিজিটালাইজেশনের কথা ভাবছে। উত্তরাধিকার আইনে নারী যখন সম্পত্তির অধিকারী হন, অটোমেটিক্যালি তিনি সেটা হবে কি না এমন কোনো সিস্টেম হবে কিনা এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি।
রিভার ও ডেল্টা রিসার্স সেন্টারের প্রতিনিধি আজাদ বলেন, ১২ জেলায় প্রতি বছর নদীভাঙন হয়। অনেকে সেখানে ভূমিহীন হয়। কোথাও ৫০০ মিটার কোথাও এক কিলোমিটার তিন-চার বছরে নদী শিফট হয়। এখানে এডি লাইন টানা হয় না। ভূমিহীনদের কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তাদের নাগরিক অধিকারটি কী। সার্ভের ক্ষেত্রে এসিল্যান্ডরা এডি লাইন টানে না।
তিনি বলেন, নদীর পাড়ের জমি দখল করে শিল্পপতিরা শিল্প করেন। ব্যাংকে সেটা মর্টগেজ হয়, নদীর জমি কীভাবে মর্টগেজ হয়। সেখানে আমাদের ম্যানেজমেন্ট কী হবে, দখল কীভাবে দূর হবে?
ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক সমাজের প্রতিনিধি নরেষ চন্দ্র বলেন, আমাদের নামে হাজার বিঘা জমি আছে সব কাগজপত্রে। অথচ আমাদের জমিজবর দখল ও জাল দলিল। ৯৭ ধারার বাস্তবায়ন চাই। সমতল অঞ্চলে ১৬টি জেলা রয়েছে। হাজার হাজার মানুষ সেখানে বাস করছে। অনেক লাঠিয়াল বাহিনী, শক্তিশালী বাহিনী সেখানে জমি জবরদখল করে পার্ক, ইন্ডাস্ট্রি বানাচ্ছে।
নদীভাঙনের শিকার মানুষের জন্য নতুন আইনে বিধান রাখা হয়েছে বলে জানান সচিব। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিকদের জমির ব্যাপারে ও সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নদীভাঙন সংক্রান্ত ভূমি ব্যবহার ও মালিকানা আইনে সিকস্তি, পয়স্তিরে একটা চ্যাপ্টার আছে। কিছু জিনিস আইনে আসবে, পুরো প্রসেসটা আমরা বিধিতে নিয়ে আসবো। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিকদের ৯৭ ধারার ব্যাপারে আমরা কাজ করছি। ১৬টা জেলার ব্যাপারে একট সার্কুলার দেব।
অর্পিত সম্পত্তির ব্যাপারে ডিসিরা রক্ষণশীল মনোভাব দেখান বলে জানান বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা কাজল দেবনাথ। তিনি বলেন, দায়বদ্ধতা নিষ্কৃতির বেনিফিট যদি উনি (ডিসি) নিতে চান, আর আমাদের সম্পদ ফেরত দিলে দায়বদ্ধতায় তিনি আসামি হবেন। এটা দ্বিচারিতা, এটা হতে পারে না। ডিসি-সরকারি আমলা থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত তাদের ধারণা অর্পিত সম্পত্তি তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি! অর্পিত সম্পত্তি দেওয়া যে কাস্টডিয়ান, সম্পূর্ণভাবে কাস্টডিয়ান এই কনসেপ্টটা নেই।
এ প্রসঙ্গে সচিব বলেন, অর্পিত সম্পত্তি কিন্তু সরকারি সম্পত্তি নয়। এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা আছে। এটা যেহেতু সরকারি সম্পত্তি নয়, তাহলে খালি খালি এর ভার আর কতদিন টানবো? আইনেও তো বিধান আছে। যেটা হচ্ছে দুটি কোর্টে রায় হতে হয়, ট্রাইব্যুনালে রায় হয়। অ্যাপিলেড ট্রাইব্যুনালে রায় হওয়ার পর লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বাধ্য এটা মিউটেশন করে দিতে। যদি না হয়, আমাদের কাছে অনেক অভিযোগ আসে, আমরা তাৎক্ষণিক অর্ডার দিয়ে করিয়ে দেই। একটা সার্কুলার দেব, যাতে এই জিনিস কেউ পেন্ডিং না রাখে। কিন্তু অ্যাপিলেড রায় না হওয়া পর্যন্ত এলেও করতে পারবে না। আইনটা রি-ডিজাইন করার জন্য আমরা ড্রাফটিং শুরু করেছি।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, মানুষের চাহিদা বাড়ছে। ভূমির দাম বাড়ছে। দামের কারণে মাটি হয়েছে সোনা। এটার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। শান্তিপূর্ণ ও ঝামেলামুক্তভাবে জমি পরের প্রজন্মের কাছে যেন দিয়ে যেতে পারে সেটা মানুষ চায়। এখানে যে সব কাজ করছি চেষ্টা করছি সেটাকে সাসটেইনেবল ও ক্যাপাসিটি বিল্ডিং করতে।
তিনি বলেন, প্রত্যেকটা জিনিস ধরে ধরে করছি। সর্বশেষ হাটবাজার সংশোধন আইনকে যুগোপযোগী করার চেষ্টা করছি। সামনে ল্যান্ড ক্রাইম অ্যাক্ট, এখানে প্রধানমন্ত্রীর স্ট্রং নির্দেশনা আছে যে তিন ফসলি জমিতে কোনো ধরনের স্থাপনা করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে আসা চিঠিতে বলা হয়েছে তিন ফসলি জমির ক্ষেত্রে যাতে কোনো আপস না করা হয়। হ্যাঁ, সরকারি কোনো কাজে…প্রাইভেট সেক্টরে আমরা এনকারেজ করবো অনলি ম্যাকানাইজ ফার্মিংয়ের ক্ষেত্রে। কারণ আমাদের জমি কমে আসছে। আমরা ভালো সিড নিয়ে এসেছি। কৃষিতে তো একটা বিপ্লব হয়ে গেছে এই সরকারের আমলে। প্রাইভেট সেক্টরকে আমরা বলছি, আপনারা যদি ম্যাকানাইজ ফার্মিংয়ে ইনভেস্ট করেন, ভালো করে তিন ফসলে ফারমিং করেন। এখানে আমাদের ফুড সেফটি নেট কিন্তু বাড়বে। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইখতেখারুজ্জামান বলেন, ডিজিটাল ডিভাইসের কারণে ভূমি সংক্রান্ত কাজ ডিজিটাল হলেও জনগণ এর সুফল পায় না। জনগণকে বঞ্চিত করার জন্য একটি শ্রেণি গড়ে ওঠে। যেটি আমরা মাঠ পর্যায়ে দেখেছি। প্রায় অর্ধেকের বেশি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যে কারণে সেবাগ্রহীতারা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।