যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) এখন প্রতি বুশেল (১ বুশেল=৬০ পাউন্ড; ১ টন=৩৬ দশমিক ৭৪ বুশেল) বিক্রি হচ্ছে ৭ ডলার ১০ সেন্টে, যা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের পর সর্বনিম্ন। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যশস্যটির দাম কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। শীর্ষ রফতানিকারক দেশ রাশিয়া থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির সরবরাহ এবার রেকর্ড ছাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আরেক শীর্ষ রফতানিকারক ইউক্রেনও এখন পণ্যটির রফতানি সম্প্রসারণের প্রয়াস চালাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায়ও এবার গমের উৎপাদন হয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে এবার আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যটির সরবরাহ চাপ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পণ্যটির দামও এখন বেশ নিম্নমুখী।
যদিও দেশের বাজারে এর কোনো প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হলে দেশে গমের কেজিপ্রতি দাম এখনকার তুলনায় অন্তত ১০-১৫ টাকা কম হওয়ার কথা। কিন্তু আমদানি কমায় পণ্যটির সরবরাহ নিয়ে বাজারে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরেও দেশে গমের আমদানি হয়েছিল ৪ হাজার টনেরও বেশি। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) আট মাস (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পেরোলেও এ সময়ের মধ্যে মোট আমদানির পরিমাণ আগের অর্থবছরের অর্ধেকেও দাঁড়ায়নি। চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৯০৭ টন গম আমদানি হয়েছে।
এ সময়ের মধ্যে সরকারি উদ্যোগে আমদানি কিছুটা বেড়েছে। যদিও ধস নেমেছে বেসরকারি খাতের আমদানিতে। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কারণে বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানির এলসি খুলতে অনীহা দেখাচ্ছে। আবার টাকার অবমূল্যায়নের কারণেও আমদানীকৃত পণ্যের দামের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। এ কারণেই দেশের বাজারে গমের মূল্য পরিস্থিতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের তেমন একটা সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশের আমদানীকৃত গমের বেশির ভাগই এখন আনা হচ্ছে ভারত থেকে। দেশটিতেও এখন গমের দাম নিম্নমুখী বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত তথ্যে উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট বাজারগুলোর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির লক্ষৌয়ের মান্ডিতে (বড় আড়ত) প্রতি কুইন্টাল (১০০ কেজি) গমের গড় মূল্য এখন ২ হাজার ৩৯০ রুপি (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ৩ হাজার ৩০ টাকা)। আসানসোলের মান্ডিতে গমের গড় মূল্য প্রতি কুইন্টাল ২ হাজার ৭৫০ রুপি (৩ হাজার ৪৮৭ টাকার সমান)। সে অনুযায়ী দেশটির বাজারে পাইকারিতে প্রতি কেজি গমের গড় মূল্য পড়ছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩০-৩৫ টাকার সমান।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, এখানে এখন ভালোমানের গম বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে। অন্যদিকে মাঝারি গ্রেডের গম বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ১ হাজার ৯২০ থেকে ১ হাজার ৯৪০ টাকায়। এ অনুযায়ী খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে মাঝারি মানের গমেরই কেজিপ্রতি মূল্য পড়ছে কমপক্ষে ৫১ টাকা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর অব্যবহিত পরও দেশে গমের মণপ্রতি দাম ছিল মাঝারি মানের ক্ষেত্রে ৯০০-৯৫০ টাকা এবং ভালো মানের ক্ষেত্রে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা। বৃহৎ দুই সরবরাহকারীর মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর অন্য অনেক স্থানের মতো বাংলাদেশেও গমের দাম বেড়ে যায়। একই সঙ্গে পণ্যটি আমদানির জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায় বাংলাদেশ। পরে তুরস্কের উদ্যোগে রাশিয়া ও ইউক্রেন আন্তর্জাতিক বাজারে গম সরবরাহের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছলে পণ্যটির দাম কমতে শুরু করে। এর মধ্যে রাশিয়া এ সমঝোতা থেকে সরে দাঁড়ালে আবার বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। নভেম্বরে রাশিয়া আবার সমঝোতায় আসার পর নিম্নমুখিতা ফিরে আসে খাদ্যশস্যটির বাজারে।
যদিও দেশের বাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। বরং গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে পাইকারিতে খাদ্যশস্যটির মণপ্রতি দাম ২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪৮০ টাকায় উঠে দাঁড়ায়। বর্তমানে দাম কমলেও বিশ্ববাজারে যেভাবে দাম কমেছে সেই অনুপাতে দেশের বাজারে দাম কমেনি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দ্য চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বিশ্ববাজারে গমের দাম বাড়তি ছিল, যার প্রভাব দেশের বাজারে পড়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দেশীয় সংকটের কারণে আমরাই চাহিদামতো আমদানি নিশ্চিত করতে পারিনি। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়াসহ ব্যবসায়ীদের একাধিক সংকট মোকাবেলা করায় আমদানি বাণিজ্য কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। বর্তমানে কিছুটা ধীরে হলেও সংকট কাটছে। আশা করা যায়, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্ববাজারের গমের দামের প্রভাব দেশের বাজারকে স্থিতিশীলতায় ফিরিয়ে আনবে।
সিবিওটির তথ্যমতে, ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে গমের গড় দাম ছিল টনপ্রতি ২৩১ ডলার ৬০ সেন্ট। পরের বছর তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৫ ডলার ২০ সেন্টে। প্রধান সরবরাহকারী দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের কারণে গত বছরজুড়ে তা আরো ১১৫ ডলার বেড়ে ৪৩০ ডলারে উঠে দাঁড়ায়। গত বছরের নভেম্বরে রাশিয়া নতুন করে শস্য রফতানিতে ছাড় দেয়া শুরু করার পর দাম আরো কমে যায়। ডিসেম্বরে দাম কমে নেমে আসে ৩৮৬ ডলার ৩০ সেন্টে। জানুয়ারিতে নেমে আসে ৩৮০ ডলার ৪০ সেন্টে।
আমদানির পাশাপাশি আশঙ্কা রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের উৎপাদন নিয়েও। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন প্রাক্কলন করা হয়েছে ১১ লাখ ৩০ হাজার টন। সেখান থেকে কমে তা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে নেমে আসতে পারে ১১ লাখ টনে। এছাড়া আমদানিও ৬৩ লাখ ৪০ হাজার টন থেকে নেমে আসতে পারে ৫০ লাখ টনে।
চট্টগ্রামভিত্তিক শস্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে শস্য সরবরাহ শুরুর পর গমের দাম টনপ্রতি ১০০ ডলারেরও বেশি কমেছে এটা সত্য। কিন্তু আমদানি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে পরিবহন খরচও বাড়তি পড়ছে। ফলে দেশের বাজারে গমের দাম এখনো সেভাবে কমেনি। তাছাড়া দেশীয় সংকটের কারণে বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানি কম হয়েছে। আগে পণ্যের সংকটকালে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বেড়ে যেত। কিন্তু এখন ডলারের সংকট ও এলসি খুলতে সময়ক্ষেপণের কারণে দেশে এখনো গমের সংকট আছে।’