মৃত্যুর ছয় বছর আগে আমেরিকান বিজনেস ম্যাগনেট ও অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস আমাদের মনের ভেতরে এক চরম সত্য ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- "তোমার সময় সংক্ষিপ্ত, তাই অচেনা এক জীবন যাপন করতে গিয়ে এই সময় নষ্ট করো না।"
অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রযুক্তি দুনিয়ার অন্যতম পথিকৃৎ স্টিভ জবস ২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গ্র্যাজুয়েটের সামনের কথাগুলো বলেছিলেন। এর কিছুদিন আগেই স্টিভ জবসের অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার ধরা পড়েছিল এবং চিকিৎসকরা বলেছিলেন, তিনি আর মাত্র তিন থেকে ছয় মাস বাঁচবেন।
মৃত্যু সন্নিকটে জেনেই বোধহয় স্টিভ জবস চেষ্টা করেছিলেন জীবনের অবশিষ্ট সময়টা সর্বোত্তমভাবে কাটাতে, আর এই বার্তাই তিনি স্ট্যানফোর্ডের সদ্য পাশ করা গ্র্যাজুয়েটদের দিয়েছিলেন। চিকিৎসকদের ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করে এরপরে আরও বছর ছয়েক বেঁচে ছিলেন জবস।
স্টিভ জবসের কথা শুনে আমাদের মনে নানা প্রশ্নের উদয় হতে পারে যে, জীবনে কোন বিষয়গুলো আসলেই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ? এখনও পর্যন্ত, স্টিভ জবসের সেই বাণী শুনলে অনেকেরই মনে হবে, আরেকবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করি এবং এর সত্য জবাব খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি!
জীবনে সুখী হওয়ার জন্য স্টিভ জবস নিজেই নিজেকে খুব সহজ তিনটি প্রশ্ন করতে বলেছিলেন।
১. যেরকম জীবন চাইতাম সেরকমই জীবনযাপন এবং যে কাজ করতে চাইতাম, সেটাই কি করছি?
মৃত্যু সন্নিকটে জেনে স্টিভ জবসের ভেতরে এক অন্যরকম শক্তি কাজ করছিলো। তিনি প্রতিটি দিনই এমনভাবে কাটাতেন যেন এটিই তার জীবনের শেষ দিন। জীবনের রস আস্বাদনে কোনো কমতি রাখেননি তিনি। এই পৃথিবীতে যে সংক্ষিপ্ত সময় নিয়ে আমরা আসি, তা নিয়ে বিষণ্ণ হয়ে থাকা কোনো কাজের কথা নয়। বরং, এটা আমাদের ভাবতে শেখায় যে সময় ভীষণ মূল্যাবান এবং এই সময়ের মধ্যেই জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে হবে।
মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়াকে স্টিভ জবস বলেছিলেন 'জীবনে সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে এমন একটি টুল'। জবসের ভাষ্যে, মৃত্যুর মুখোমুখি হলে আমাদের ভয়, ব্যর্থতা, গর্ব সবকিছু কেটে যায়; থাকে শুধু সেই জিনিস যা সত্যিই দরকারি।
২. আজই যদি জীবনের শেষ দিন হতো, আমি কি করতে চাইতাম?
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের সতর্কবাণী পাওয়ার পর থেকে নিজেকে প্রতিদিন এই একটি প্রশ্ন করতেন স্টিভ জবস। তিনি সত্যিকার অর্থেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এই প্রশ্নটি করতেন।
জবস বলেন, "টানা বেশ কয়েকদিন যখন এই প্রশ্নের উত্তর এলো 'না', তখন আমি বুঝলাম কিছু একটা পরিবর্তন করতে হবে।"
নিজে নিজের মুখোমুখি হওয়া খুব জরুরি। দিনের শুরুতেই নিজেকে উপরে উল্লিখিত প্রশ্নটি করুন। আপনার জন্য সামনে কী অপেক্ষা করে আছে সেদিকে মনোযোগ দিন। নিজে নিজের কাছে সৎ থাকুন। আপনি যে জীবন চান, তা যদি আপনি না পেয়ে থাকেন, সেটা স্বীকার করাটা কষ্টের। কিন্তু নতুন কিছু অর্জনের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হলে, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে এই সত্য স্বীকার করতেই হবে।
৩. যা করতে ভালোবাসি তা-ই করছি তো?
স্টিভ জবস বলেছিলেন, একটা অচেনা জীবন পার করা মানেই নিজের জীবন নষ্ট করা। এর বদলে তিনি সবাইকে পরামর্শ দেন খুঁজে বের করতে যে, আপনার যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল তা কি আপনি করছেন?
আপনার নিজের কী পছন্দ, কী ভালোবাসেন তা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে। কাজ অবশ্যই জীবনের একটা বড় অংশ... আর নিজে যা বিশ্বাস করি, তার ওপর ভিত্তি করে কাজ করতে পারাটা তো দারুণ! আর দারুণ কাজ করার শর্ত হলো- নিজের প্রিয় কাজ করা।
নিজের প্রিয় কাজ করতে পারলে বেঁচে থাকার প্রেরণা পাওয়া যায়, যা আমাদের পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে সাহায্য করে। মার্কিন বিলিয়নিয়ার ওয়ারেন বাফেটের ভাষ্যে তা 'ট্যাপ ডান্স টু ওয়ার্ক'। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, কাজে লিপ্ত থাকতে এবং সুখী থাকতে চাইলে, সবার আগে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আমার কাজটা গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার কাজের মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ কোনো উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে।
অনেকেই দিনরাত কলুর বলদের মতো কাজ করে যান, কিন্তু জীবনে কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিক করতে পারেন না। কিন্তু কাজের পেছনে উদ্দেশ্য খুঁজে পেলে আমরা শুধুমাত্র সুখীই হবো না, আমাদের কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। আর যদি কেউ না-ই জানেন যে তার কি কি প্রিয়, তাহলে তা আগে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। শুধু কোনো প্রতিবেদনের লেখকের কথায় বিশ্বাস করবেন না যেন!