এগারো বছর পূর্বের মৃত ব্যক্তিকে এখনো পরিচালক হিসেবে দেখাচ্ছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একটি বিমা কোম্পানি। একইসঙ্গে মৃত ব্যক্তির শেয়ার বন্ধক রেখে একটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণও নেওয়া হয়েছে। এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটিয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। একই সঙ্গে মৃত ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক দেখানোর বিষয়টি স্বীকারও করেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে মৃত ওই পরিচালকের নামের কিছু অংশ পরিবর্তন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থসংবাদের অনুসন্ধানে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
সূত্র মতে, রূপালী ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক মো. নাজিম উদ্দিন খান ২০১২ সালের ১৮ মে ধানমন্ডির কম্পোর্ট নার্সিং হোমে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অথচ ১১ বছর পরও নাজিম উদ্দিনকে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দেখাচ্ছে রূপালী ইন্স্যুরেন্স।
জানা গেছে, ২০১০ সালে নাজিম উদ্দিন খান ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডে বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) খোলেন। বিও হিসাব নং: ১২০১৯৫০০৩৯৩৩১৩৬৩। তাঁর বিও হিসাবে বর্তমানে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের ২১ লাখ ১৫ হাজার ৮০২টি শেয়ার রয়েছে। তার মধ্যে ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৮৬৪টি শেয়ার বন্ধক দেখাচ্ছে ইবিএল সিকিউরিটিজ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইবিএল সিকিউরিটিজ থেকে উত্তরা ফাইন্যান্স ক্যাপিটালে এ শেয়ারগুলো বন্ধক (Pledge) দেওয়া হয়েছে। কিভাবে এই শেয়ার বন্ধক দেওয়া হলো তার কোন সদুত্তর দিতে পারেনি ইবিএল সিকিউরিটিজ এবং রূপালী ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ। ২০১২ সালে নাজিম উদ্দিন খানের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা শেয়ার বুঝে নিতে চাইলেও কালক্ষেপন করতে থাকে রূপালী ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবি (সেন্ট্রাল ইনফরমেশন ব্যুরো) প্রতিবেদন অনুযায়ী নাজিম উদ্দিনের নামে কোন ঋণ নেই। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে নাজিম উদ্দিনের শেয়ার বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছে কে? কিভাবে ইবিএল সিকিউরিটিজ থেকে উত্তরা ফাইন্যান্সে লিয়েন করে ঋণ নেওয়া হলো? আর এই ঋণের অনুমতিই বা দিয়েছে কে? এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দুই প্রতিষ্ঠান।
সূত্র মতে, উচ্চ আদালতের আদেশের পর গত ২ মে মৃত পরিচালকের উত্তরাধিকারীদের শেয়ার বুঝে নিতে অনাপত্তি দেয় রূপালী ইন্স্যুরেন্স। যদিও এখনো শেয়ার বুঝে নিতে পারেননি নাজিম উদ্দিন খানের উত্তরাধিকারীরা। রূপালী ইন্স্যুরেন্স, উত্তরা ফাইন্যান্স এবং ইবিএল সিকিউরিটিজের যোগসাজশে তাঁরা শেয়ার বুঝে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। নাজিম উদ্দিন খানের পরিবারের পক্ষ থেকে গত ১৮ই মে ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে নাজিম উদ্দিনের শেয়ার কার নির্দেশে এবং কবে বন্ধক রাখা হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মৃত নাজিম উদ্দিন খানের বড় ছেলে সিরাজ উদ্দিন খান মিন্টু অর্থসংবাদকে বলেন, আমার বড় মামা একসময় রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর বড় মামি এসব বিষয় দেখভাল করতেন। আমরা তখন এসব বিষয়ে বুঝতাম না। এখন উচ্চ আদালতের আদেশের পর রূপালী ইন্স্যুরেন্স সম্প্রতি শেয়ার স্থানান্তরে অনাপত্তি দিয়েছে। অনাপত্তি পেয়ে ইবিএল সিকিউরিটিজে যোগাযোগ করলে জানতে পারি শেয়ারগুলো বন্ধক অবস্থায় আছে। তবে কেন বন্ধক রয়েছে, সে বিষয়ে তাঁরা কিছু বলছে না। তাঁরা আমাদেরকে বলেছেন সিডিবিএল থেকে শেয়ার লক ফ্রি করে আনতে। পরে আমরা সিডিবিএলে যোগাযোগ করলে সংস্থাটি জানায় এটি তাদের কাজ নয়। বরং সিডিবিএল থেকে আমাদের এ বিষয়ে অভিযোগ দিতে বলা হয়।
সূত্র মতে, মো. নাজিম উদ্দিন খান ২০১২ সালে মারা গেলেও গত এগারো বছর ধরেই তাকে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক হিসেবে দেখাচ্ছে কোম্পানিটি। প্রতিষ্ঠানটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। যদিও মো. নাজিম উদ্দিন খানকে শুধু নাজিম উদ্দিন হিসেবে দেখিয়েছে রূপালী ইন্স্যুরেন্স। একই সঙ্গে কোম্পানিটির অন্যান্য পরিচালকের ছবি থাকলেও বার্ষিক প্রতিবেদনে নাজিম উদ্দিনের কোন ছবি নেই। এছাড়াও ইবিএল সিকিউরিটিজ নাজিম উদ্দিন খানের বিও হিসাবের ছবি পরিবর্তন করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর স্বজনরা। যার সত্যতাও মিলেছে অর্থসংবাদের অনুসন্ধানে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছায়েদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ চেষ্টা করলেও সম্ভব হয়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির সিডিবিএলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরহাদ মোর্শেদ সনি অর্থসংবাদকে বলেন, মো. নাজিম উদ্দিনের বিও হিসাব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি স্থগিত রেখেছে। বিএসইসিতে স্থগিতের জন্য তাঁর (নাজিম উদ্দিন) উত্তরাধিকারীরাই আবেদন করেছে বলে তিনি দাবি করেন।
তিনি বলেন, আমরা তো জিম্মাদার। উনাদের বলেছি স্থগিতাদেশ তুলে নিন। উত্তরা ফাইন্যান্সে কিভাবে শেয়ার প্লেজ (বন্ধক) করা হয়েছে সেটি ক্লায়েন্ট (নাজিম উদ্দিন) আর রূপালী ইন্স্যুরেন্স বলতে পারবে। ক্লায়েন্টের বিও হিসাবের নাম আর ডেথ সার্টিফিকেটের নামে মিল নেই। মূলত ইবিএল সিকিউরিটিজ এ বিষয়ে কিছুই জানে না।
ফরহাদ মোর্শেদ আরও বলেন, তাদেরকে (নাজিম উদ্দিনের উত্তরাধিকারী) অসহযোগিতা করার কিছুই নেই। হাইকোর্টের আদেশ যেহেতু নিয়ে আসছে, আমরা দিতে বাধ্য। কিন্তু বিও হিসাব স্থগিত থাকায় আমরা শেয়ার বুঝিয়ে দিতে পারছি না। তবে নাজিম উদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বিও হিসাব স্থগিত করার জন্য তাঁরা কোথাও কোন আবেদনই করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহীনুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেন, কি কারণে শেয়ার বন্ধক রাখা হয়েছে, তা সুস্পস্টভাবে বলা কঠিন। মূলত ঋণের বিপরীতে শেয়ার বন্ধক রাখা হয়। শেয়ার বন্ধক আমাদের কাছে থাকলেও বন্ধকের কারণ আমরা বলতে পারবো না। এটি মূল কোম্পানি (উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড) বলতে পারবে।
জানতে চাইলে রূপালী ইন্স্যুরেন্সর কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আতিকুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেন, নাজিম উদ্দিন খান ২০২২ সাল পর্যন্ত পরিচালক ছিলেন, এখন আর নেই। তিনি যে ২০১২ সালে মারা গেছে সেটি আমাদের কেউ জানায়নি। তাই তিনি এতদিন পর্ষদে ছিলেন। একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পরও কিভাবে পরিচালক থাকেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগুলো পরিচালকদের বিষয়। ফোনে আমি এসব বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।
একজন ব্যক্তি ২০১২ সালে মারা গেলেও পাঁচ বছর পর (২০১৭ সাল) কিভাবে তাঁর শেয়ার বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে কোম্পানি সচিব বলেন, সেটি আমি জানি না, এটি যাদের শেয়ার তাঁরা জানেন। লিয়েন করতে কি কোম্পানিকে জিজ্ঞেস করতে হয়? মূলত আমি ওই সময় রূপালী ইন্স্যুরেন্সে কোম্পানি সচিব ছিলাম না। তবে আমরা এখন নাজিম উদ্দিন খানের উত্তরাধিকারীদের শেয়ার হস্তান্তরের অনুমতি দিয়েছি। শেয়ার হস্তান্তর যেহেতু পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের বিষয়, তাই একটু সময় লাগছে।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন অর্থসংবাদকে বলেন, যদি এ ধরণের ঘটনা ঘটে থাকে সেটি অবশ্যই নজিরবিহীন, চাঞ্চল্যকর এবং অনিয়ম। শেয়ার লিয়েন এবং প্লেজ করা বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব না। এ ধরণের ঘটনা ঘটে থাকলে বোর্ডের সবাই এর জন্য দায়ী। একজন মৃত ব্যক্তি তো দূরের কথা, কেউ বোর্ড মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকলে সেটির কারণও জানাতে হয়। সেখানে মৃত ব্যক্তিকে পর্ষদে রাখা তো বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছাড়া সম্ভব নয়। এর জন্য পুরো বোর্ডই রেসপন্সিবল।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। এসআরএমআইসি বিভাগ এ বিষয়টি দেখভাল করে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কমিশন দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালের উত্তরাধিকার আইনের ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী নাজিম উদ্দিন খানের স্ত্রী-সন্তানদের রূপালী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার বুঝিয়ে দিতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী, নাজিম উদ্দিন খানের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে- তাঁর স্ত্রী হাজী রোকেয়া বেগম ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪৭৫টি শেয়ার পাবেন। দুই ছেলে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৮৩১টি করে শেয়ার পাবেন। আর চার কন্যা রহিমা জামান, ফাহিমা ওয়াহিদ, শামীমা নামিজ এবং সায়মা নাজিম প্রত্যেকেই পাবেন ২ লাখ ৩১ হাজার ৪১৫টি শেয়ার।