তবে বিশেষজ্ঞ ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টার্নওভার কর বাড়ানো হলে তা তুলনামূলক ছোট এবং নতুন কোম্পানিগুলোর ওপর অতিরিক্ত বোঝা তৈরি করতে পারে। এছাড়া, এত বেশি টার্নওভার করের কারণে নতুন কোম্পানি এ খাতে ব্যবসায় নাও আসতে পারে।
কার্বনেটেড বেভারেজ শিল্পের ওপর বিদ্যমান টার্নওভার করের হার ০.৬০ শতাংশ, যা আগামী অর্থবছর থেকে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তারা আরও জানান, কাঁচামাল আমদানির জন্য প্রদত্ত অগ্রিম আয়কর ন্যূনতম কর হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
সেইসঙ্গে, সিগারেটের দাম প্রায় ১২.৫ শতাংশ বাড়িয়ে এই পণ্য থেকেও আরও বেশি রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এছাড়া, নিম্নস্তরের সিগারেটের ওপর আরও ১ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে বলেও জানান কর্মকর্তারা।
তবে বিশেষজ্ঞ ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টার্নওভার কর বাড়ানো হলে তা তুলনামূলক ছোট এবং নতুন কোম্পানিগুলোর ওপর অতিরিক্ত বোঝা তৈরি করতে পারে। এছাড়া, এত বেশি টার্নওভার করের কারণে নতুন কোম্পানি এ খাতে ব্যবসায় নাও আসতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি পানীয় কোম্পানির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা বলেন, বড় কোম্পানিগুলো কর্পোরেট কর হারের আওতায় তাদের ওপর প্রযোজ্য রিটার্ন জমা দিচ্ছে; ফলে মুনাফা করা সত্ত্বেও তারা টার্নওভার কর দিচ্ছে না।
তবে টার্নওভার কর বৃদ্ধির এই পদক্ষেপে কোম্পানিগুলো পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "এই সেক্টরের একটি বড় কোম্পানি হওয়ায় আমরা টার্নওভার কর নয়, নিয়মিত কর দিচ্ছি।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বেশিরভাগ বড় পানীয় কোম্পানি নিয়মিত কর দিচ্ছে।
কামরুজ্জামান কাঁচামালের শুল্ক কাঠামো সংশোধন করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, উচ্চ ডলার বিনিময় হার, জ্বালানি ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রতিটি বেভারেজ কোম্পানিই এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
বাংলাদেশ বেভারেজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, এই সেক্টরের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকা এবং কিছু বড় কোম্পানি ইতোমধ্যেই প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের বিনিয়োগ রয়েছে ৮০০ কোটি টাকার বেশি।
কোকা-কোলা ফ্র্যাঞ্চাইজি ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ এবং আবদুল মোনেম লিমিটেড এই খাতে যথাক্রমে ৭১৬ কোটি টাকা এবং ২৯০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
ট্রান্সকম বেভারেজ করেছে ৭৫৬ কোটি টাকা, গ্লোব সফট ড্রিংকস ৫৬৫ কোটি, এএসটি বেভারেজ ৩৮৪ কোটি, প্রাণ বেভারেজ ৪৮৫ কোটি, পারটেক্স বেভারেজ ২২৯ কোটি, সজীব কর্পোরেশন ১৪০ কোটি এবং মেঘনা গ্রুপ ৩৩৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
দেশে পানীয় উৎপাদন ও বিতরণ খাতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
নিম্নস্তরের সিগারেট থেকেই বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য
রাজস্ব আদায়ের সহজ উপায় হিসেবে এবারও সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যকেই বেছে নিচ্ছে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ (এনবিআর)।
এরমধ্যে লোয়ার সেগমেন্টের সিগারেটের দাম ১২.৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪০ টাকা থেকে ৪৫ টাকা করা হতে পারে। পাশাপাশি বাড়তে পারে সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি বা সম্পূরক শুল্কও। এতে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক ১ শতাংশ বেড়ে ৫৮ শতাংশ হতে পারে। পুরো সিগারেটের বাজারে এই সেগমেন্টের দখলে রয়েছে প্রায় ৭৩ শতাংশ।
এছাড়া সিগারেটের অন্যান্য স্তরেও মূল্য বাড়তে পারে। তবে ওইসব খাতে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক অপরিবর্তিত থাকতে পারে বলে জানান গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এর মাধ্যমে বাড়তি ৬,০০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে এনবিআরের।
সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে অর্থমন্ত্রী অর্থ বিলের মাধ্যমে এ ধরনের প্রস্তাব দিতে পারেন।
ট্যাক্স-টু-জিডিপি (জিডিপিতে রাজস্বের অবদান) বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপ রয়েছে। আবার স্থানীয় তামাক বিরোধী জোটগুলোও তামাকের কর বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে।
যদিও সিগারেটের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি তামাকজাত পণ্য নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য পন্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাবেক এনবিআরর চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, "সিগারেটের দাম বাড়ানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আদায় হবে। কিন্তু তামাকের ব্যবহার কমাতে হলে এর পাশাপাশি নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার তৈরি করতে হবে কার্যকরভাবে। অন্যথায় সরকারের রাজস্ব বাড়বে, কিন্তু তামাকের ব্যবহার কমবে না।"
বর্তমানে বাজারে বিপণনকৃত সিগারেটকে চার স্তরে ভাগ করে এর ওপর সরকার নির্ধারিত মূল্য বসানো হয় এবং অ্যাড ভ্যালোরেম হিসেবে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়।
এর মধ্যে মধ্যম স্তরের সিগারেটের (১০ স্টিকের এক প্যাকেট) বিদ্যমান দাম ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৭ টাকা, হায়ার সেগমেন্ট ১১১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৩ টাকা ও প্রিমিয়াম সেগমেন্ট ১৪২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করা হতে পারে। এই তিন স্তরে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
২০২১ অর্থবছরে তামাকজাত পণ্য থেকে ২৯,৬০০ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ৩২,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে এনবিআরের কর্মকর্তারা আশা করছেন। আর নতুন মূল্যস্তর নির্ধারণ ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি স্ট্রাকচারে পরিবর্তন আনার ফলে এ খাত থেকে আগামী অর্থবছরে আদায় হতে পারে ৩৮,০০০ কোটি টাকার বেশি।
এছাড়া, সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা তরল নিকোটিন, ট্রান্সডার্মাল নিকোটিন বা এ জাতীয় পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১৫০ শতাংশ এবং ইলেক্ট্রনিক সিগারেট ও সমজাতীয় ডিভাইস ও পার্টসের ওপর শুল্ককর ২১২ শতাংশ বাড়তে পারে।
দেশে সিগারেটের বাজারের বড় অংশই ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো লিমিটেডের দখলে। এছাড়া, জাপান টোবাকো ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ইউনাইটেড ঢাকা টোবাকো কোম্পানি লিমিটেডসহ ছোটবড় বেশকিছু কোম্পানি রয়েছে।