জানা গেছে, অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্রোকারেজ হাউজটি একটি বেসরকারি ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। তবে এই ঋণ কেলেঙ্কারিতে সহযোগিতার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পুঁজিবাজারের বৃহত্তর স্বার্থে ব্রোকারেজ হাউজটির নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত রয়েছে অর্থসংবাদ।
সূত্র জানায়, রুপালী ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন মো. নাজিম উদ্দিন খান। ২০১২ সালের ১৮ মে ধানমন্ডির কম্পোর্ট নার্সিং হোমে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। অথচ ১১ বছর পরও নাজিম উদ্দিনকে নিজেদের পরিচালক হিসেবে দেখিয়েছে রুপালী ইন্স্যুরেন্স। ২০১২ সালে মারা যাওয়া নাজিম উদ্দিনের শেয়ার বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া হয় ২০১৫ সালে।
জানা গেছে, মৃত্যুর পরও নাজিম উদ্দিন খানকে অসৎ উদ্দেশ্যেই পরিচালনা পর্ষদে রেখেছে রুপালী ইন্স্যুরেন্স। বিষয়টি এতদিন কেউ না জানলেও সম্প্রতি নাজিম উদ্দিনের উত্তরাধিকারীরা কোম্পানির শেয়ার নিজেদের নামে হস্তান্তর করতে চাইলেই বাঁধে বিপত্তি। কেঁচো খুড়তেই বেরিয়ে আসে সাঁপ। নাজিম উদ্দিনের শেয়ার বন্ধক (Pledge) রেখে ঋণ নেওয়া হয়েছে একটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। মৃত ব্যক্তির নামে কিভাবে ঋণ নেওয়া হলো সেটি নিয়ে ওঠে প্রশ্ন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাজিম উদ্দিন খানের শেয়ার বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছেন রুপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক ফজলুতুন নেছা। ২০১৫ সালে মৃত পরিচালকের শেয়ার বন্ধক রেখে সাড়ে তিন কোটি টাকা ঋণ নেন তিনি। দুই দফায় উত্তরা ফাইন্যান্স ক্যাপিটালের প্রধান কার্যালয় থেকে এ ঋণ ফজলুতুন নেছার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঋণ গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এক টাকাও পরিশোধ করেননি ফজলুতুন নেছা। মৃত নাজিম উদ্দিনের নামে নেওয়া এই ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। অর্থঋণ আদালতে এ সংক্রান্ত একটি মামলা চলছে।
সূত্র জানায়, মৃত নাজিম উদ্দিনের শেয়ার বন্ধক দিয়ে ঋণ নেওয়া ফজলুতুন নেছা রুপালী ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের স্ত্রী। কোম্পানির চেয়ারম্যানের স্ত্রী হওয়ায় পরিচালনা পর্ষদের অন্য সদস্যরাও এই অনিয়মের বিষয়ে কোন কথা বলার সাহস পায়নি। অর্থাৎ পুরো পর্ষদের সম্মতিতেই এ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। কারণ পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি ছাড়া কোন ঋণের জন্য কোম্পানির শেয়ার বন্ধক রাখা যায় না।
বিশ্লেষকদের মতে, রুপালী ইন্স্যুরেন্সের পুরো পরিচালনা পর্ষদ এ ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকতে পারে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, একজন পরিচালক মারা গেলে সেটি বোর্ড অবশ্যই জানার কথা। কেননা প্রতি মাসে একটি কোম্পানি একাধিক পর্ষদ সভা করে। এসব সভায় পরিচালকদের উপস্থিত থাকতে হয়। কোন কারণে পরপর তিনটি পর্ষদ সভায় কোন সদস্য অনুপস্থিত থাকলে তাঁর পরিচালক পদ বাতিল হয়ে যায়। অথচ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একজন পরিচালক পর্ষদ সভায় উপস্থিত হয়নি, তাকে বছরের পর বছর পর্ষদে রাখা হয়েছে কাগজে-কলমে।
সূত্র মতে, ২০১০ সালে নাজিম উদ্দিন খান বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) খোলেন। বিও হিসাব নং: ১২০১৯৫০০৩৯৩৩১৩৬৩। তাঁর বিও হিসাবে বর্তমানে রুপালী ইন্স্যুরেন্সের ২১ লাখ ১৫ হাজার ৮০২টি শেয়ার রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৮৬৪টি শেয়ার বন্ধক দেখানো হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরা ফাইন্যান্স ক্যাপিটালে এ শেয়ারগুলো বন্ধক (Pledge) দেওয়া হয়েছে। কিভাবে এই শেয়ার বন্ধক দেওয়া হলো তার কোন সদুত্তর দিতে পারেনি উত্তরা ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল এবং রুপালী ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ। ২০১২ সালে নাজিম উদ্দিন খানের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা রুপালী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার বুঝে নিতে চাইলেও কালক্ষেপন করতে থাকে কোম্পানিটি।
এ বিষয়ে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আতিকুর রহমান অর্থসংবাদকে বলেন, এটি উনাদের (চেয়ারম্যান ও পরিচালক) বিষয়। অর্থসংবাদে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত আগের প্রতিবেদনকে মিথ্যা দাবি করে প্রতিবাদ বার্তা দিয়েছেন, অথচ আমাদের কাছে উপযুক্ত প্রমাণ আছে- প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। এরপর বিষয়টি নিয়ে পরে কথা বলবো বলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি। একইসঙ্গে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি। এ চাঞ্চল্যকর কেলেঙ্কারির সময় (২০১৫ সাল) প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্বে থাকা পি.কে রয়কে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি। এছাড়াও রূপালী ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী অর্থসংবাদকে বলেন, এটি ফৌজদারী অপরাধ। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁদের আদালতের শরণাপন্ন হওয়া উচিৎ। আমরাও (আইডিআরএ) বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। যেহেতু রূপালী ইন্স্যুরেন্স পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত, তাই বিএসইসি এ বিষয়টি দেখবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে এ বিষয়টি কমিশনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। মৃত ব্যক্তিকে পরিচালক দেখানো এবং তাঁর শেয়ার বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকলে কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ অর্থসংবাদকে বলেন, কোন কোম্পানির পরিচালকের মৃত্যু হলে বা পরিবর্তন হলে কোম্পানি আইনের আওতায় নির্দিষ্ট ফর্মের মাধ্যমে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিকে জানাতে হবে। এটা জানানোর দায়িত্ব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের। আর যদি কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় তাহলে বিএসইসিকেও জানাতে হবে। বিএসইসি এটা দেখবে। আর যদি মৃত ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে ঋণ নেয় সেটি বেআইনি। মৃত ব্যক্তি কিভাবে ঋণের দায় নেবে? তিনি তো মারাই গেছেন।
উল্লেখ্য, মৃত নাজিম উদ্দিনের নামে নেওয়া ঋণ বর্তমানে সুদসহ প্রায় ১০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। পরিশোধ না করায় বর্তমানে এটি খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও অর্থঋণ আদালতে এ সংক্রান্ত একটি মামলা চলছে।