এদিকে মাস্টার ফিডের বিষয়ে আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের গুঞ্জন রয়েছে বাজারে। এই কোম্পানিটির প্লেসমেন্ট শেয়ার হোল্ডার একাধিক ব্যাক্তির সঙ্গে আলাপকালে আরও ভয়াবহ তথ্য জানা গেছে। দেশের শেয়ারবাজরের বিতর্কিত কয়েকেজন ব্যক্তির যোগসাজসে এই কোম্পানিটিকে মূল মার্কেটে তালিকাভুক্ত করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে এসএমইতে তালিকাভুক্ত হয়। ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে কোম্পানিটির প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে সেগুলো এখন সাধারন বিনিয়োগকারীদেরকে ধরিয়ে দিচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের দাবী নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তদন্ত করলেই প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসবে।
সূত্র জানায়, মাস্টার ফিড এগ্রোটেকের পরিচালক রফিকুল আলম গত বছরের ১৫ জুলাই মারা যান। তাঁর কাছে মাস্টার ফিডের ৭০ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার ছিল। এরপর চলতি বছরের মার্চ মাসের ১ তারিখে কোম্পানিটির মৃত এ পরিচালকের শেয়ার হস্তান্তরের ঘোষণা দেয় মাস্টার ফিডের পক্ষ থেকে।
জানা গেছে, মাস্টার ফিড এগ্রোটেকের এই পরিচালকের স্ত্রী উম্মে হাবিবা ইয়াছমিন গত ৫ মার্চ তার পাসপোর্ট ও ব্যাংক হিসাবের চেকের ফটো কপি দিয়ে ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজ লিমিটেডে বিও একাউন্ট (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) চালু করেন। তার সেই বিওতে মে মাসের ৫ তারিখে মাস্টার ফিডের ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৫০০টি শেয়ার জমা হয়। একই মাসের ৪ থেকে ২৩ তারিখের মধ্যে একই কোম্পানির আরও ১৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭০৮টি শেয়ার জমা হয়। পরবর্তীতে তিনি সব শেয়ার বিক্রি করেন এবং একই সঙ্গে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। অল্প সময়ের মধ্যে পর পর বড় অংকের টাকা উত্তোলন করায় বিষয়টি ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজ লিমিটেডের নজরে আসে। ফলে ব্রোকারেজ হাউজটির চিফ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অফিসার (সিএএমএলও) এই বিও একাউন্টের সকল তথ্য যাচাই শুরু করেন।
এদিকে অনুসন্ধানে উঠে আসে নানান অসঙ্গতি। বিও একাউন্টে দেওয়া মোবাইল নাম্বারটি গ্রাহক উম্মে হাবিবা ইয়াছমিনের নিজের নয়। নাম্বারটি ছিল তাঁর বোন ইভা আকতারের। ইভা আকতার উম্মে হাবিবার বিও একাউন্টের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি অথচ তিনি নমিনিকে ( উম্মে হাবিবা) চেনেন না। এছাড়াও বিও একাউন্টের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হিসেবে ছিল আবুল বাসার নামের একজন, যিনি মাস্টার ফিডের কোস্পানি সচিব। একই ব্যক্তি গত ২১ মে সুমন রাতুল নামে ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে মুঠোফোনে কল দেন। তখন তিনি মাস্টার ফিড এগ্রোটেকের কোম্পানি সচিব পরিচয় দেন এবং উম্মে হাবিবা পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন বলে জানান। এরপর গ্রাহক সুস্থ হলে এনআইডি, পাসপোর্ট ও ডিএসইতে দাখিলকৃত ডকুমেন্টসের সব কপি নিয়ে অফিসে আসতে বলেন ব্রোকারেজের সিইও। কিন্তু পরবর্তীতে শুধুমাত্র আদালতের সাকসেশন সার্টিফিকেটের ফটো কপি জমা দেন উম্মে হাবিবা।
সূত্র জানায়, উত্তরাধিকার সনদ অনুযায়ী উম্মে হাবিবা রফিকুল আলমের স্ত্রী। কিন্তু তাঁর দাখিলকৃত পাসপোর্টে তার স্বামীর নাম মো. মোকাদ্দেম হোসাইন। যার ইস্যু তারিখ ২৬ নভেম্বর ২০১৮ এবং মেয়াদউত্তীর্ণ তারিখ ২৫ নভেম্বর ২০২৩। এছাড়া, বিওতে দেওয়া তাঁর পেশা ও ঠিকানা জাতীয় পরিচয় পত্রের সাথে মিল নেই। একই সঙ্গে তাঁর বিওতে নমিনী হিসেবে পেয়ার উদ্দিনকে কাজিন উল্লেখ করেছেন অথচ তিনি মাস্টার ফিড এগ্রোটেকের একজন কর্মচারী। তাঁর সাথে উম্মে হাবিবার কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, উত্তরাধিকার সনদ অনুযায়ী রফিকুল আলমের পিতা আবদুর রশিদ তার পুত্রবধু উম্মে হাবিবার পক্ষে টাকা উত্তোলনের অনুমোদন পেলেও মাস্টার ফিড এগ্রোটেক কোম্পানি কর্তৃপক্ষ উম্মে হাবিবার বিওতে বেআইনিভাবে শেয়ার স্থানান্তর করে। এছাডাও ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজের সিইও কাউসার আল মামুনের প্রশ্নে উম্মে হাবিবা জানান, সাউথইস্ট ব্যাংকে কখন একাউন্ট খুলেছেন তা তিনি জানেন না। গত ১৬ জুলাই পর্যন্ত তাঁর সাউথইস্ট ব্যাংকের হিসাবে কত টাকা জমা হয়েছে তাও তিনি জানেন না। তিনি জানান, তার স্বামী রফিকুল আলম ৪২ বছর বয়সে মারা যান।উম্মে হাবিবা তাঁর শ্বশুরের নামও ভুলে গেছেন। তিনি উত্তরার বাসায় ১ বছর ৬ মাস বসবাস করেছেন কিন্তু বাসার বিল্ডিংয়ের নাম কি সেটাও জানেন না।
সূত্র জানায়, উম্মে হাবিবা তাঁর বিও একাউন্টের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মো. আবুল বাসারকে তিনি চেনেন না। এসব বিষযসমূহ অধিকতর সত্যানুসন্ধানের জন্য মো. কাউসার আল মামুন অফিসের সিনিয়র অফিসার আরজুকে উত্তরার বাসার ঠিকানায় পাঠান। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা রফিকুল আলমকে চেনেন না এবং এই নামে কোনো ব্যক্তি এ ঠিকানায় ছিলো না বলে জানান।
এদিকে গত ১৬ জুলাই মাস্টার ফিড এগ্রোটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কবির হোসেন ৪/৫ জন লোকসহ একজন মহিলাকে নিয়ে ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজের অফিসে আসেন। সেখানে মো. কবির হোসেন মহিলাটিকে উম্মে হাবিবা পরিচয় দিয়ে তার এনআইডির সাথে ভেরিফাই করতে বলেন। তবে অন্য কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করেন তিনি। এসময় বিও হিসাবের ডকুমেন্টের উপর ভিত্তি করে উম্মে হাবিবাকে প্রশ্ন করতেই ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাউসার আল মামুনের উপর ক্ষেপে যান এবং মারমুখী আচরণ করেন। পরবর্তীতে হুমকি দিয়ে অফিস থেকে চলে যান। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কাউসার আল মামুন অর্থসংবাদকে বলেন, মাস্টার ফিড এগ্রোটেকের পরিচালক রফিকুল আলমের স্ত্রী উম্মে হাবিবা ইয়াছমিন। তিনি বিও একাউন্ট থেকে পর পর বড় অংকের টাকা উত্তোলন করায় বিষয়টি নজরে আসে। সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে এনআইডি পাসপোর্ট ও ডিএসইতে দাখিলকৃত ডকুমেন্টসের ফটো কপি নিয়ে আসতে বলি। তবে তিনি অনেক সময় নিয়েও শুধু মাত্র আদালতের সাকসেশন সার্টিফিকেটের ফটো কপি পাঠান।
মো. কাউসার আল মামুন আরও বলেন, মাস্টার ফিড এগ্রোটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ উম্মে হাবিবা ইয়াছমিন একদিন আমার অফিসে আসেন। তাঁরা উম্মে হাবিবাকে অন্য কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস না করার শর্ত দিয়ে এনআইডির সাথে ভেরিফাই করতে বলেন। কিন্তু ব্যাংক একাউন্ট নিয়ে কথা বলা মাত্রই ক্ষেপে যায় এবং তাঁরা মারমুখী আচরণ করেন। এই বিও হিসাবধারী আরও বড় অংকের অর্থ উত্তোলনের চেষ্টায় ছিলেন বলেও জানান ফার্স্ট ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজের এই কর্মকর্তা।
এ প্রসঙ্গে মাস্টার ফিড এগ্রোটেকের কোম্পানি সেক্রেটারি এবং বিও একাউন্টের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সুমন রাতুল ওরফে মো. আবুল বাসার অর্থসংবাদকে জানান, পরিচালক রফিকুল আলমের মৃত্যুর পর হাইকোর্টের সাকসেশন অনুযায়ী ৭৫ শতাংশ শেয়ার পেয়েছে তাঁর বাবা। আর বাকি ২৫ শতাংশ শেয়ার পেয়েছেন রফিকুল আলমের স্ত্রী উম্মে হাবিবা ইয়াছমিন। রফিকুল আলম উম্মে হাবিবার দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন বলেও জানান তিনি।
মাস্টার ফিডের কোম্পানি সেক্রেটারি হয়েও আপনি উম্মে হাবিবার বিও একাউন্টের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি কিভাবে হলেন? আবুল বাসারকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, কোম্পানির পরিচলক মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী ও ইমিডিয়েট ডিরেক্টর অনুরোধ করেন বিষয়টি সমাধান করার। এ থেকেই তিনি আমাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছেন। আর এই ইমিডিয়েট ডিরেক্টরও মারা গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, মাস্টার ফিড এগ্রোটেকের পরিচালকের শেয়ার জালিয়াতির অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের বিষয়টি কমিশন তদন্ত করে দেখবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কমিশন দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল-আমিন অর্থসংবাদকে বলেন, বাজার সংশ্লিষ্ট যেকোনো অভিযোগ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত টিম অনুসন্ধান করে থাকেন। এ বিষয়ে যেহেতু অভিযোগ উঠেছে কমিশন অবশ্যই তদন্ত করে দেখবে।
তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারে যারা জালিয়াতি করে তারা বিষয়টি প্রথমে সামনে নিয়ে আসতে চায় না। গোপন রাখতে চায়। তাই বিনিয়োগকারীদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে এসব অভিযোগগুলো দ্রুত তদন্ত ও সমাধানের আহ্বান জানান।