বিষয়টি নিয়ে টেলিনরের মালিকানাধীন গ্রামীণফোন এখনো পুরোপুরি নীরব অবস্থানে রয়েছে। যদিও নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়-দায়িত্ব পুরোপুরি টেলিনর এশিয়া ও নরওয়েতে টেলিনরের মূল প্রতিষ্ঠানের। এ বিষয়ে টেলিনরের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের আগে ঢাকায় কোনো কিছু জানা সম্ভব নয়।
বর্তমানে এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় ব্যবসা করছে টেলিনর। গত বছরের অক্টোবরে সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেলিনর এশিয়া গঠনের পর থেকে এ অঞ্চলের ব্যবসা পুনর্গঠনের দিকে নজর দিয়েছে গ্রুপটি। টেলিনর এশিয়া গঠনের পরের মাসেই মালয়েশিয়ায় আজিয়াটার সঙ্গে টেলিনরের একীভূতকরণের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এ বছরের মার্চে থাইল্যান্ডে একীভূতকরণ করা হয় দেশটিতে টেলিনরের মালিকানাধীন টেলিকম অপারেটর ডিটাককে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির পাকিস্তান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা প্রথম আলোচনায় আসে গত বছরের শেষ দিকে। সে সময় আরব আমিরাতভিত্তিক এক বহুজাতিকের টেলিনর পাকিস্তানের ব্যবসা কিনে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। এর বাইরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে, বর্তমানে পাকিস্তানের সম্পদ বিক্রি করে দেয়ার পাশাপাশি সব ধরনের বিকল্প খতিয়ে দেখছে টেলিনর। যদিও পরে এক টুইট বার্তার মাধ্যমে বিষয়টিকে গুজব বলে দাবি করে টেলিনর পাকিস্তান।
টেলিনরের এশিয়া অঞ্চলের ব্যবসা নিয়ে সম্প্রতি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে গ্রুপটির ব্যবসার নানা দিক নিয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেছেন টেলিনরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিগভে ব্রেক্কে। তার মতে, মিয়ানমার থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার বিষয়টি টেলিনরের বিনিয়োগকারীদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ইউনিটগুলোকে একটি স্বতন্ত্র ইউনিটের অধীনে আনার ফলে বিভিন্ন ধরনের কৌশলগত বিকল্প বেছে নেয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এর মধ্যে একীভূতকরণও রয়েছে।
মিয়ানমারের ব্যবসা টেলিনরের বাজার মূলধনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে উল্লেখ করে সিগভে ব্রেক্কে বলেন, ‘এশিয়ায় আমাদের অন্যান্য সম্পদ নিয়েও বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটিও এশিয়ায় আমাদের ভিন্নভাবে গঠন করার আরেকটি কারণ। এতে আমাদের সামনে আসা ঝুঁকিগুলোকে ভালোভাবে মোকাবেলা করা যাবে।’
এ সময় স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে যৌথ অংশীদারত্ব ছাড়া আগামী পাঁচ বছর পর এশিয়ায় টেলিনর নিজের উপস্থিতি টিকিয়ে রাখবে কিনা জানতে চাইলে এ বিষয়ে ‘আমি এখনই ভাবতে চাই না’ বলে মন্তব্য করেন সিগভে ব্রেক্কে।
এশিয়ায় পশ্চিমা টেলিকম অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কঠিন সময় পার করছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক এরই মধ্যে টেলিনরকে এশিয়া ছেড়ে যাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। যদিও টেলিনরের মোট গ্রাহকের ৯৫ শতাংশই এশিয়ার। এর পরিবর্তে তারা গ্রুপটিকে পুরোপুরিভাবে নর্ডিক অঞ্চলে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এশিয়ায় টেলিনর ব্যবসা করছে ২৫ বছর ধরে। এখানকার ব্যবসার বিষয়ে ব্রেক্কে বলেন, ‘এ মহাদেশে আমরা যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছি, লভ্যাংশ হিসেবে সে পরিমাণ অর্থ এরই মধ্যে তুলে নিয়েছি, যার পরিমাণ ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রের আভাস, বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে আগামী বছর সিদ্ধান্ত নিতে পারে টেলিনর। এক্ষেত্রে মূল প্রভাবক হতে পারে এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নিয়ন্ত্রক কাঠামো ও কর ব্যবস্থার মতো বিষয়গুলো। স্থানীয় এক শীর্ষ ব্যবসায়ী টেলিনর বাংলাদেশ থেকে চলে গেলে গ্রামীণফোনের শেয়ার কিনতে আগ্রহী বলে করপোরেট মহলে আলোচনা রয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় ওই প্রতিষ্ঠানটিরও শেয়ার কিনে নিয়েছিলেন তিনি।
তবে বাংলাদেশে পরিস্থিতি এখনো টেলিনরের প্রতিকূলে আসেনি বলে মনে করছেন লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ গবেষক ও টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান। তিনি বলেন, ‘গ্রামীণফোন টেলিনরের একমাত্র কোম্পানি, যারা অপটিক্যাল ফাইবারে বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশের বাজারে একক আধিপত্য রয়েছে কোম্পানিটির। তাছাড়া অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকেই এখন টেলিনরের সবচেয়ে বেশি রিটার্ন আসছে।’
যদিও বাংলাদেশে টেলিকম অপারেটরদের ব্যবসা এখন কঠিন হয়ে গেছে বলে মনে করছেন টেলিকম বিশেষজ্ঞ ও রবি আজিয়াটা বাংলাদেশের সাবেক সিইও মাহতাব উদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের বিপরীতে প্রত্যাশিত রিটার্ন আসছে না। বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করে স্পেকট্রাম কেনার পর কোম্পানিগুলো সেটি কাজে লাগাতে পারছে না। এর বড় অংশই অব্যবহৃত থাকছে। সামনে ফাইভজির জন্য আরো বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের বাজারে আর্থসামাজিক, কর ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো সংক্রান্ত বেশকিছু ঝুঁকি রয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের এখানে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। তবে সরকার যদি টেলিকম অপারেটরদের প্রয়োজনে প্রণোদনা দিয়ে হলেও স্পেকট্রামের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এতে একদিকে গ্রাহকরা বাড়তি সুবিধা পাবেন, অন্যদিকে অপারেটরদের আয় বাড়াতেও তা ভূমিকা রাখবে। এটি দুই পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।’
টেলিনরের ২০২২ পঞ্জিকাবর্ষের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে গ্রুপটির এশিয়া অঞ্চলের গ্রাহক সংখ্যা ২০ কোটি ২০ লাখে দাঁড়িয়েছে। গত বছর নর্ডিক অঞ্চলের চার দেশ থেকে টেলিনরের ৫ হাজার ৬৪৭ কোটি ১০ লাখ ক্রোনা আয় এসেছে। আর এশিয়ার তিন দেশ থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে এসেছে ৪ হাজার ২৪৮ কোটি ২০ লাখ ক্রোনা (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী ১ নরওয়েজিয়ান ক্রোনা = ১০ টাকা ৭৫ পয়সা)। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে এসেছে ১ হাজার ৫৩৯ কোটি ২০ লাখ ক্রোনা (বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৬ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার কিছু বেশি)। সব মিলিয়ে গত বছর গ্রুপটির মোট আয় হয়েছে ৯ হাজার ৮৯৫ কোটি ৩০ লাখ ক্রোনা।
গত বছরের নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদের মালিকানায় থাকা সেলকমের সঙ্গে ও টেলিনর এশিয়া পিটিই লিমিটেডের মালিকানাধীন ডিগিডটকম বারহাদ একীভূত হয়। একীভূতকরণের পর নতুন কোম্পানিটির নাম হয়েছে সেলকম ডিগি। এ কোম্পানিতে আজিয়াটা ও টেলিনর উভয়েরই ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। একীভূতকরণের পর সেলকম ডিগি মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় টেলিকম অপারেটরে পরিণত হয়েছে।
এ বছরের মার্চে থাইল্যান্ডে টেলিনর এশিয়া সিপি গ্রুপের সঙ্গে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্নের কথা জানায়। দেশটিতে টেলিনরের মালিকানাধীন ডিটাক একীভূত হয়ে ট্রু করপোরেশন নামে নতুন কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নতুন এ কোম্পানিতে টেলিনর ও সিপি গ্রুপের সমানসংখ্যক ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। এ একীভূতকরণকে থাইল্যান্ডের টেলিকম বাজারে একটি মাইলস্টোন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতায় ২০২২ সালের মার্চে দেশটি থেকে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা জানায় টেলিনর। তারা লেবানিজ বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান এম ওয়ান গ্রুপের কাছে শতভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। মিয়ানমারে অবস্থিত বিদেশী টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি গ্রহণ ব্যতীত দেশ ছাড়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছিল জান্তা সরকার। সেই সঙ্গে জনগণের ওপর নজরদারি বাড়াতে আড়িপাতা যন্ত্র স্থাপনে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। সে সময় টেলিনরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিগভে ব্রেক্কে বলেন, ‘মিয়ানমারে গত কয়েক মাসে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা জননিরাপত্তা, নীতিনির্ধারণ ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা সম্ভাব্য সব ধরনের পথ খুঁজেছি। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় কোম্পানিটি বিক্রি করে দেয়াকে যথোপযুক্ত মনে করছি।’
এর আগে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স জিওর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ভারতের বাজার থেকে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছিল টেলিনর গ্রুপ। সেই সময় ভারতী এয়ারটেলের কাছে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে ভারতের বাজার থেকে বেরিয়ে যায় টেলিনর গ্রুপ।