আরব আমিরাত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় বছরেই প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী হয়েছেন আমিরাতে। তবুও রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করা বাংলাদেশী শ্রমিকদের অবস্থান ষষ্ঠ। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান ভারতীয়রা। দ্বিতীয় স্থানটি পাকিস্তানিদের। সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠানোর দিক থেকে তৃতীয় ফিলিপাইন, চতুর্থ ইরান ও ও পঞ্চম স্থানে মিসর।
অভিযোগ রয়েছে, আরব আমিরাতে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশই আসছে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশটি এখন বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারেরও অন্যতম প্রধান গন্তব্য হয়ে উঠছে।
সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইউএইর (সিবিইউএই) ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে আরব আমিরাত থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেমিট্যান্স হিসেবে গেছে ১৪৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন দিরহাম (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৩৯ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ)। এর অর্ধেকেরও বেশি গেছে ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনে। কেবল ভারতেই গেছে প্রায় সাড়ে ৩০ শতাংশ, যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন দিরহামের মতো। সর্বশেষ বিনিময় হারের ভিত্তিতে হিসাব করলে দেখা যায়, ইউএই থেকে ২৮ লাখ ভারতীয় গত বছর ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স নিজ দেশে পাঠিয়েছেন।
একই সময়ে আরব আমিরাত থেকে বের হওয়া রেমিট্যান্সের ১২ দশমিক ২ শতাংশ গেছে পাকিস্তানে, যার পরিমাণ প্রায় ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন দিরহাম। ডলারে রূপান্তর করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৮৪ কোটি বা ৪ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে বসবাসরত পাকিস্তানির সংখ্যা ১২ লাখ ৯০ হাজার। একই সময়ে ইউএইর বহির্মুখী রেমিট্যান্সের ৮ দশমিক ৪ শতাংশ গেছে ফিলিপাইনে। সে অনুযায়ী দেশটিতে গত বছর ইউএই থেকে রেমিট্যান্স গেছে প্রায় ১২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন দিরহাম। ডলারে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৩৩ কোটি বা ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন। ইউএইতে ফিলিপাইনের নাগরিক রয়েছেন ৫ লাখ ৭০ হাজার।
ইউএইতে ৪ লাখ ৮০ হাজার অভিবাসী আছে ইরানের। আর মিসরের অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যাও ৪ লাখ ৩০ হাজারের মতো। কিন্তু এ দুটি দেশের অভিবাসীরা নিজ দেশে বাংলাদেশীদের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। মিসরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে আরব আমিরাত প্রবাসী মিসরীয়রা ৩৪০ কোটি বা ৩ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার নিজ দেশে পাঠিয়েছেন। ইরানও প্রায় কাছাকাছি রেমিট্যান্স আহরণ করছে ইউএই থেকে। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি থেকে মাত্র ২০৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কিছুটা বাড়লেও সেটি ৩০৩ কোটি ডলারেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আরব আমিরাতে বিশেষ করে দেশটির দুবাইয়ের বিভিন্ন খাতে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশীদের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের তথ্য উঠে এসেছে। দেশের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই এখন দুবাইকে বেছে নিয়েছে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কেন্দ্র হিসেবে। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ থেকে অনেক ব্যবসায়ী ওই শহরে অনানুষ্ঠানিক অফিস খুলে সেখান থেকে ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
দুবাই তথা আরব আমিরাত থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রেমিট্যান্স না আসার পেছনে এটিকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, হুন্ডি-হাওলার এজেন্টরা সেখানে বাড়তি সুবিধা দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে রেমিট্যান্সের অর্থ সংগ্রহ করছে। আর দেশে তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশী টাকায় সমপরিমাণ অর্থ পৌঁছে দিচ্ছে প্রবাসীদের পরিবারের কাছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, আরব আমিরাতে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২১ সালে সংস্থাটির সনদ নিয়ে ২৯ হাজারের বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক আমিরাত প্রবাসী হয়েছেন। ২০২২ সালে গেছেন ১ লাখ ১ হাজার ৭৭৫ জন। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গেছেন ৪২ হাজারেরও বেশি। আবার উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী শিক্ষার্থীও এখন আরব আমিরাত যাচ্ছেন। তাদের অনেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশটির কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক লোক এ দেশ থেকে আমিরাত গেলেও রেমিট্যান্স প্রবাহে তার প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে না। উল্টো ২০২১-২২ পর্যন্ত টানা তিন অর্থবছর ধরে বাংলাদেশে ইউএই থেকে রেমিট্যান্স কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরেও দেশটি থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪৭ কোটি ডলারের বেশি। পরের বছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় প্রায় ২৪৪ কোটিতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা আরো কমে ২০৭ কোটি ডলারে নেমে আসে। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষের দিকে ইউএই থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। এ কারণে অর্থবছর শেষে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০৩ কোটি ডলার।
অর্থসংবাদ/এমআই