ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে আবেদন জানিয়ে সাত আমানতকারীর করা মামলার শুনানি শেষে রোববার এ আদেশ দেন বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ। আদেশটি গতকাল প্রকাশিত হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে দেউলিয়া ঘোষণা করার আরজি জানিয়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আবেদনটি করেছিলেন সাত আমানতকারী। যদিও আদালত দেউলিয়া ঘোষণার পথে না গিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।
এ বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আইএলএফএসএলকে দেউলিয়া ঘোষণা না করে যদি অভিজ্ঞ, সৎ, দক্ষতাসম্পন্নদের দিয়ে কোম্পানিটিকে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে অংশীদার ও আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
এজন্যই আদালত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে জানানোর জন্য কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ দেন।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আদালতের আদেশের বিষয়টি শুনেছি। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো নথি এখনো পাইনি। আমার স্বাস্থ্যগত অবস্থা ভালো নেই। তার পরও উচ্চ আদালত যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেটিকে আমি সম্মান জানাই। আমি প্রতিষ্ঠানটির ব্যালান্সশিটসহ অন্য বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করব। এরপর যদি মনে হয়, সেটি টেনে তোলা সম্ভব, তবেই দায়িত্ব নেব। অন্যথায় বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই।
তিনি আরো বলেন, উচ্চ আদালত এর আগে পিপলস লিজিং অবসায়ন করার বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু তার ফল ভালো হয়নি। এখনো প্রতিষ্ঠানটির আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই আদালত ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে দেউলিয়া ঘোষণা না করে মেরামত করতে চাইছেন। জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার হিসেবেই হয়তো আমাকে এ দায়িত্ব নিতে বলেছেন।
ঘোষিত আদেশে হাইকোর্ট একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠনকারী প্রশান্ত কুমার হালদারসহ (পি কে হালদার) ২০ জনের সব সম্পদ ও পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এদের নগদ অর্থ, গাড়ি, মজুদসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কোনো ব্যক্তি বা সত্তার কাছে যাতে হস্তান্তরিত না হয়, সেটি নিশ্চিতেরও নির্দেশনা দিয়েছেন। এ তালিকায় পি কে হালদারের মা, স্ত্রী, ভাই ও পিপলস লিজিংয়ের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার নামও উল্লেখ করা হয়েছে।
পি কে হালদার ছাড়াও যাদের পাসপোর্ট জব্দ করতে বলা হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বর্তমান চেয়ারম্যান এমএ হাশেম, পরিচালক এম নুরুল আলম, মো. জহিরুল আলম, নাসিম আনোয়ার, বাসুদেব ব্যানার্জী, পাপিয়া ব্যানার্জী, মমতাজ বেগম, মো. নওশেরুল ইসলাম, মো. আনোয়ারুল কবির, প্রকৌশলী নুরুজ্জামান, মোহাম্মদ আবুল হাশেম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল হক, পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, ভাই প্রিতুষ কুমার হালদার, আত্মীয় অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারী, বন্ধু উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান উদ্দিন আহমেদ।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র সচিবকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত, যাতে তাদের কেউই কোনোভাবে দেশ ছাড়তে না পারেন। এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করে ১৫ দিনের মধ্যে আদালতকে বিষয়টি সম্পর্কে জানানোরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল এগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেনচার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হল ইন্টারন্যাশনাল, হল ট্র্যাভেলস, হল ট্রিপ, হল ক্যাপিটাল, হল টেকনোলজি, আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, সুখন্দা লিমিটেড অ্যান্ড রেপটাইল ফার্ম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ প্রতিবেদন ১৫ দিনের মধ্যে যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের নিবন্ধককে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আদালতে আবেদনকারীদের পক্ষের আইনজীবী এএসএম শাহরিয়ার কবির সাংবাদিকদের বলেন, সাত আবেদনকারী স্থায়ী আমানত হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা জমা দিয়েছিলেন। আমানত পরিপক্ব হওয়ার পর আমানতকারীরা তাদের টাকা উত্তোলনের জন্য আবেদন করেছিলেন। সে সময় তাদের জানানো হয়, আইএলএফএসএল আমানতের টাকা দিতে অক্ষম। এ পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা কোম্পানিটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করার আরজি জানিয়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্টে আবেদন করেন।
সর্বশেষ ১২ জানুয়ারি আইএলএফএসএলের পক্ষ থেকে আদালতে একটি লিখিত আবেদন দিয়ে বলা হয়, বর্তমান অবস্থায় কোম্পানি একসঙ্গে সব পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করতে পারবে না। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবেদনকারীদের অর্থ ফেরত দেবে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মোট সম্পদ ছিল ৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা ঋণ ও লিজ হিসেবে গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্রাহকদের আমানত ছিল ৪ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা ছিল মেয়াদি আমানত। বিদায়ী বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৪ কোটি টাকা। সঞ্চিতি ও সরকারকে কর পরিশোধের পর প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ছিল মাত্র ২ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক যারা
আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে ২০১৫ সালে। ওই সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, এমডিসহ প্রায় সব পদে পরিবর্তন আসে। যদিও আগে থেকেই অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল প্রতিষ্ঠানটির তত্কালীন পর্ষদ। এ পরিবর্তনের পরই সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমএ হাশেম ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। ২০১৫ সালের ৭ মে থেকে এ পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এর আগে একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে যোগ দেন এমএ হাশেম। এর আগে ১৯৯৭-৯৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের এমডি ছিলেন তিনি। এরও আগে সোনালী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বর্তমানে বিডিবিএল) ও রূপালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ছিলেন এমএ হাশেম। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ছাড়াও বর্তমানে গ্রিনল্যান্ড ইকুইটিস লিমিটেড ও ট্রান্সভেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তিনি।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অন্যতম পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন এম নূরুল আলম। শ ওয়ালাস বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। ওই প্রতিষ্ঠানটির মনোনীত পরিচালক হিসেবে এম নূরুল আলম ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক হয়েছেন। এসডব্লিউ শিপিং লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির এমডি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন।
২০১৫ সালের ১৩ মে থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মো. জহিরুল আলম। ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) এ সদস্য এর আগে বিশ্বব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, তিতাস গ্যাস, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন।
একই বছরের ১৬ এপ্রিল থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন নাসিম আনোয়ার। নিউ টেক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির মনোনীত পরিচালক তিনি। আইসিএবির এ সদস্য ‘হুসাইন ফরহাদ অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস’ নামের একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। এছাড়া দেশী-বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করেছেন তিনি। ফিন্যান্স ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন টিকে গ্রুপেও।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালকদের একজন বাসুদেব ব্যানার্জী। তিনি ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল বিআর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মনোনীত পরিচালক হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক হন। এমএসটি মেরিন সার্ভিস অ্যান্ড ট্রেডার্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার তিনি।
বাসুদেব ব্যানার্জীর স্ত্রী পাপিয়া ব্যানার্জীও আছেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পর্ষদে। ২০১৫ সালেই তিনি নিউ টেক এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মনোনীত পরিচালক হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদে যোগ দেন। তিনি দিয়া শিপিং লিমিটেড, টিকমার্কস শিপিং লিমিটেড, আমাদের মেরিন কোম্পানি লিমিটেড, দিয়া অয়েল লিমিটেড নামে একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
২০১৫ সালের ২৮ জুন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক হন মমতাজ বেগম। ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মনোনীত পরিচালক তিনি। বাসুদেব ব্যানার্জী ও তার স্ত্রী পাপিয়া ব্যানার্জীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোয় মমতাজ বেগমেরও অংশীদারিত্ব আছে। তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের আরেক পরিচালক মো. নওশেরুল ইসলামের স্ত্রী।
নওশেরুল ইসলামও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সালের ৭ মে যোগ দেন। স্ত্রীর মতো তিনিও ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মনোনীত পরিচালক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ কর্মকর্তা এমএসটি গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার।
২০১৫ সালের ৭ মে থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পর্ষদে আছেন মো. আনোয়ারুল কবির । তিনি বিআর ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মনোনীত।
২০১৫ সালের ২৮ জুন থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পর্ষদে আছেন প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান। তিনি স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদে যুক্ত হন। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবীও।
২০১৬ সালের শুরুতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক হন মুহাম্মদ আবুল হাশেম। তিনিও শ ওয়ালাস বাংলাদেশ লিমিটেডের পক্ষ থেকে মনোনীত পরিচালক।